সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আইডাহো, আর্কানসাস ও টেনেসির রিপাবলিকান গভর্নররা আইভারমেকটিন নামের পরজীবীনাশক ওষুধটি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা-বেচার অনুমতি দিয়ে আইনে সই করেছেন। পশ্চিম ভার্জিনিয়া, দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও লুইজিয়ানাসহ আরও অনেক রাজ্যের আইনপ্রণেতাও দ্রুত একই পথে হাঁটতে উদ্গ্রিব।
পক্ষপাতীরা এই পদক্ষেপকে ‘মেডিক্যাল ফ্রিডম’ আন্দোলনের বিজয় হিসেবে প্রচার করলেও, বিষয়টি আসলে জনস্বাস্থ্যের প্রতি গভীর অনাস্থার প্রতীক, যা রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের ‘মেক আমেরিকা হেলদি অ্যাগেইন’ কর্মসূচির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।
দীর্ঘদিনের পশু ডি-ওয়ার্মার আইভারমেকটিন কীভাবে এমন তর্কের বিষয়ে পরিণত হলো, সেটা ফিরে দেখার মতো। পশুচিকিৎসায় তৈরি হওয়া ওষুধটি কুকুর-বিড়াল ও ঘোড়া, গরু, শূকরসহ খামারের প্রাণীতে হার্টওয়ার্ম প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি মানুষের পরজীবী সংক্রমণেরও চিকিৎসা করে এবং নদী অন্ধত্ব (অনকোসারকিয়াসিস) মোকাবিলায় পছন্দের ওষুধ; এ রোগ বিশ্বজুড়ে সংক্রমণজনিত অন্ধত্বের দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ। যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অনকোসারকিয়াসিস ও স্ট্রংগিলয়ডিয়াসিস নামের আরেক পরজীবী সংক্রমণের চিকিৎসায় ট্যাবলেট আকারের আইভারমেকটিন অনুমোদন দিয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতে ল্যাবরেটরির সেল কালচারে ভাইরাস প্রতিলিপি থামাতে আইভারমেকটিন কার্যকর হতে পারে—এমন তথ্য পাওয়ায় ওষুধটি সম্ভাব্য চিকিৎসার তালিকায় উঠে আসে। কিন্তু মানবদেহে করা পরীক্ষায় সেই ফলাফল পুনরায় মেলেনি।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত দুটি গবেষণা জানায়, আইভারমেকটিন কোভিডজনিত জরুরি বিভাগে ভর্তির হার, হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু কমায় না। জেএএমএ-তে উচ্চ মাত্রার আইভারমেকটিন নিয়ে করা আরেক গবেষণাও হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি হ্রাস বা উপসর্গের স্থায়িত্ব কমানোর ক্ষেত্রে কোনো সুফল পায়নি। চিকিৎসাবিষয়ক স্বর্ণমানদণ্ড কোকরেন-এর ১১টি ট্রায়াল বিশ্লেষণও কোভিড প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় আইভারমেকটিনের পক্ষে কোনো প্রমাণ পায়নি।
বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়: সম্ভাবনাময় তত্ত্বকে কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি করা হয়, সব ফল সমভাবে বিবেচিত হয়। কোনো ওষুধ নির্দিষ্ট রোগে অকার্যকর প্রমাণিত হলে সেই উদ্দেশ্যে তার ব্যবহার যৌক্তিক নয়।
কিন্তু সবাই এই বৈজ্ঞানিক নীতিমালা মানতে রাজি ছিলেন না। বিপরীত প্রমাণ সত্ত্বেও ‘আমেরিকার ফ্রন্টলাইন ডাক্টরস’ নামের একটি গোষ্ঠী আইভারমেকটিনকে কোভিড-১৯-এর ‘নিরাপদ ও কার্যকর চিকিৎসা’ বলে প্রচার চালায়। ‘ইন্ডিপেনডেন্ট মেডিক্যাল অ্যালায়েন্স’ নামে আরেক গোষ্ঠী দাবি করে, ওষুধ কোম্পানিগুলো আইভারমেকটিনকে কোভিড চিকিৎসায় পুনঃব্যবহারের তথ্য গোপন করছে। বিধিনিষেধ দ্রুত তুলে নিতে ইচ্ছুক আইনপ্রণেতারা এসব চিকিৎসকদের শুনানিতে ডাকেন। এক চিকিৎসক সিনেট কমিটিতে বলেন, ‘আইভারমেকটিন নিলে আপনি অসুস্থ হবেন না।’
ফক্স নিউজের লরা ইনগ্রাহাম ও পডকাস্টার জো রোগানের মতো বহু ডানপন্থী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আইভারমেকটিনের প্রশংসা করেন; রোগান তো কোভিডে আক্রান্ত হলে নিজেই তা সেবনের কথা জানান। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ওষুধটির বিক্রি মহামারির আগের তুলনায় দশ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন না পেয়ে অনেকে পশুর জন্য তৈরি আইভারমেকটিন কিনতে শুরু করেন, ফলস্বরূপ ঘোড়া-গরুর ফর্মুলেশন খেয়ে গুরুতর অসুস্থতার ঘটনার পর এফডিএ সতর্কতা জারি করে। কোভিডে মৃতপ্রায় স্বজনকে বাঁচাতে মরিয়া পরিবারগুলো আদালতে গিয়ে হাসপাতালকে জোর করে ওষুধটি দিতে বাধ্য করার পদক্ষেপ নেয়।
অর্থাৎ আইভারমেকটিন কোভিড-১৯ সংস্কৃতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মাস্ক ও টিকার মতোই এই ওষুধ রাজনৈতিক আনুগত্যের সাংকেতিক রূপ পায়।
টিকা-সংশয়ীরা আইভারমেকটিনকে শেষ ভরসা হিসেবে দেখেন। সংক্রমিত হলে ওষুধটি খেলেই চলবে চিকিৎসা—এমন বিশ্বাস থেকে তারা মাস্ক বা টিকার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেন। গবেষণায় আইভারমেকটিন অকেজো প্রমাণিত হলেও তারা তা মানতে নারাজ; বরং ধারণা করেন, মূলধারার চিকিৎসাব্যবস্থা ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে মিলে জনগণকে জোর করে টিকা দিচ্ছে। ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে আইভারমেকটিনের পক্ষে কথা বলা লোকের অভাবও নেই।
সে কারণে প্রেসক্রিপশন তো দূরের কথা, ফার্মাসিস্টের পরামর্শ ছাড়াই আইভারমেকটিন কেনার অনুমতি দিতে আইন পাস হওয়া আশ্চর্য নয়। এই সাফল্যের পর সমর্থকেরা একই কৌশল টিকা-প্রাপ্যতা কমাতেও প্রয়োগ করছেন। কয়েকটি রাজ্যে এমআরএনএ টিকা নিষিদ্ধ বা এমনকি সেটি দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ চলছে—যে প্রযুক্তি দ্রুতগতিতে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি সম্ভব করেছিল।
এখানে ভণ্ডামি চোখে পড়ার মতো: একটি ওষুধের অবাধ প্রাপ্যতার দাবিদাররা আবার অন্য ওষুধের নাগাল প্রতিহত করতে চান। বোঝাই যাচ্ছে, ‘মেডিক্যাল ফ্রিডম’ কেবল সেই সব থেরাপিতেই প্রযোজ্য, যেগুলোকে মূলধারার চিকিৎসা নিরুৎসাহিত করে।
তাদের অগ্রগতি থেমে নেই। ফেডারেল সরকার ঘোষণা দিয়েছে—করোনাভাইরাসের টিকা কে পাবে, তার সীমা টানা হবে; আর গত সপ্তাহেই কেনেডির স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ বার্ড ফ্লুর টিকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কয়েক শ মিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা এমন এক উল্টো পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি, যেখানে অপ্রমাণিত চিকিৎসাপদ্ধতিকে উৎসবের মতো স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের বেদিতে বলি দেওয়া হচ্ছে।