১২:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

জাসিন্ডা আর্ডার্নের আত্মজীবনী: সহমর্মিতা ও সদয় নেতৃত্বের নতুন পাঠ

নেতৃত্বের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন তাঁর নতুন আত্মজীবনী “A Different Kind of Power”–এ বিশ্বকে এক বিকল্প নেতৃত্বের দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন—সেটি হলো সহানুভূতি ও সদয়তার ভিত্তিতে নেতৃত্ব। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বকালীন সময়ে তিনি ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং কোভিড-১৯ মহামারির মতো একাধিক সংকট মোকাবিলা করেছেন।

হার্ভার্ডে জাস্ট জাসিন্ডা

নেতৃত্ব ত্যাগ করার পর এখন তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ফেলোশিপে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সময় তিনি নিজের নাম ও অবস্থান আড়াল করে এক সাধারণ জীবনের স্বাদ নিচ্ছেন। এক ক্যাফেতে কফি অর্ডার করার সময় ক্যাশিয়ার ভুল করে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী টোনি কোলেট মনে করেন, কিন্তু আর্ডার্ন সেই ভুল শুধরে দেন না—এ যেন তাঁর নতুন জীবনের প্রতিচ্ছবি।

বইটি কেন এবং কীভাবে

বইটি লেখা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর। যদিও বিশ্বের রাজনীতি তখন এক অস্থির সময় অতিক্রম করছিল, আর্ডার্ন মনে করেন, তখনও এবং এখনও, সদয় নেতৃত্বকে “নাইভ” বলে আখ্যা দেওয়া ভুল।

তিনি বলেন, বর্তমান নেতৃত্বের ধারা দেখে অনেকেই ভুলভাবে ধরে নেন, মানুষ এই ধরনের কঠোর ও বিভক্তিকর নেতৃত্ব চায়। অথচ মানুষ সত্যিকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ও মানবিক নেতৃত্বকেই মূল্য দেয়।

নারীত্ব ও নেতৃত্ব: দ্বন্দ্ব ও সাহস

আর্ডার্ন তাঁর বইয়ে খোলাখুলি বলেছেন, সহানুভূতি প্রকাশ করা এক সময় তাঁকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে—এই আশঙ্কা ছিল। তারওপর, এই দুর্বলতাকে অনেকেই নারীত্বের বৈশিষ্ট্য মনে করেন।

তিনি বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি শুধু নিজের মতো করেই নেতৃত্ব দেব। নিউজিল্যান্ডে আপনি যদি নিজের মতো না হন, মানুষ সেটা ধরতে দেরি করে না।”

তিনি আরও বলেন, “কখনও কখনও আবেগ প্রকাশ না করাটা উপযুক্ত ছিল না কারণ সেটা ছিল ভুক্তভোগীদের সময়। আবার কিছু সময়ে মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেওয়াই সঠিক পথ।”

মা ও প্রধানমন্ত্রীএকসঙ্গে দুই ভূমিকা

আর্ডার্ন বিশ্বে দ্বিতীয় সরকারপ্রধান যিনি ক্ষমতায় থাকার সময় সন্তান জন্ম দেন। তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে নিজের গর্ভাবস্থার খবর জানতে একটি বন্ধুর বাথরুমে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন—সেই সময়ই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আলোচনা চলছিল। সন্তান জন্মের পর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নেন—সেখানে কখনও সন্তানের ডায়াপার পাল্টাচ্ছেন, কখনও বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। তার কয়েক বছর পর জাতিসংঘে নতুন মায়েদের জন্য একটি নার্সিং স্পেস চালু হয়।

এই অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতাগুলিই তাঁর মূল বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করে: সহানুভূতির সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়া মানবিক এবং কার্যকর।

নারী নেতাদের জন্য প্রত্যাশা?

আর্ডার্ন বলেন, “আমি নারী বা পুরুষ নির্বিশেষে বহু রাজনীতিকের মধ্যে সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব দেখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যেসব গুণ আমরা আমাদের সন্তানের মধ্যে চাই, যেমন দয়া, উদারতা, সাহস, সেগুলোকেই কেন আমরা নেতার মধ্যে দুর্বলতা মনে করি?”

নিজের জীবন কতটা প্রকাশ করবেন?

আর্ডার্ন বলেন, “আমার ওপর একটা দায়িত্ব ছিল দেখানোর যে, একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে মা হওয়াও সম্ভব। কিন্তু একইসঙ্গে আমি চেয়েছিলাম না যেন মনে হয় আমি সব একা করছি—ওয়ান্ডার ওম্যানের মতো নয়।”

তাঁর ছয় সপ্তাহ পর মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত অনেককে বিস্মিত করেছিল। যদিও তাঁর সরকার ছয় মাসের পিতৃত্ব ছুটির কথা বলেছিল, তিনি বলেন, “আমি ছয় মাস নিখোঁজ থাকতে পারি না। আমি নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী।”

তিনি বলেন, “শারীরিকভাবে আমি তখনও পুরোপুরি সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিলাম না। বুঝি না নারীরা কীভাবে আরও আগেই কাজে ফিরে যান।”

গেরিয়াট্রিক মাদার’ শব্দটি কেন?

বইয়ে তিনি “গেরিয়াট্রিক মাদার” শব্দটি উল্লেখ করে বলেন, “এই পরিভাষা বদলানোর সময় এসেছে। কেন না একজন মা যদি বয়সে একটু বড়ও হন, তাতে তিনি ‘seasoned’ হতে পারেন, কিন্তু ‘বৃদ্ধ’ বলা উচিত নয়।”

ফিরে আসার আভাস

এই আত্মজীবনী প্রকাশ এবং একটি প্রামাণ্যচিত্র (যার নাম Prime Minister)—যা এই মাসেই মুক্তি পাবে—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, জাসিন্ডা আর্ডার্ন ধীরে ধীরে আবারও জনজীবনে ফিরে আসছেন। তবে এবার হয়তো এক নতুন রূপে—আরও মানবিক, আরও সরল এবং আরও কাছের একজন মানুষ হিসেবে।

জাসিন্ডা আর্ডার্নের আত্মজীবনী: সহমর্মিতা ও সদয় নেতৃত্বের নতুন পাঠ

০৫:৫৭:১০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

নেতৃত্বের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন তাঁর নতুন আত্মজীবনী “A Different Kind of Power”–এ বিশ্বকে এক বিকল্প নেতৃত্বের দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন—সেটি হলো সহানুভূতি ও সদয়তার ভিত্তিতে নেতৃত্ব। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বকালীন সময়ে তিনি ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলা, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং কোভিড-১৯ মহামারির মতো একাধিক সংকট মোকাবিলা করেছেন।

হার্ভার্ডে জাস্ট জাসিন্ডা

নেতৃত্ব ত্যাগ করার পর এখন তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ফেলোশিপে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সময় তিনি নিজের নাম ও অবস্থান আড়াল করে এক সাধারণ জীবনের স্বাদ নিচ্ছেন। এক ক্যাফেতে কফি অর্ডার করার সময় ক্যাশিয়ার ভুল করে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী টোনি কোলেট মনে করেন, কিন্তু আর্ডার্ন সেই ভুল শুধরে দেন না—এ যেন তাঁর নতুন জীবনের প্রতিচ্ছবি।

বইটি কেন এবং কীভাবে

বইটি লেখা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর। যদিও বিশ্বের রাজনীতি তখন এক অস্থির সময় অতিক্রম করছিল, আর্ডার্ন মনে করেন, তখনও এবং এখনও, সদয় নেতৃত্বকে “নাইভ” বলে আখ্যা দেওয়া ভুল।

তিনি বলেন, বর্তমান নেতৃত্বের ধারা দেখে অনেকেই ভুলভাবে ধরে নেন, মানুষ এই ধরনের কঠোর ও বিভক্তিকর নেতৃত্ব চায়। অথচ মানুষ সত্যিকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ও মানবিক নেতৃত্বকেই মূল্য দেয়।

নারীত্ব ও নেতৃত্ব: দ্বন্দ্ব ও সাহস

আর্ডার্ন তাঁর বইয়ে খোলাখুলি বলেছেন, সহানুভূতি প্রকাশ করা এক সময় তাঁকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে—এই আশঙ্কা ছিল। তারওপর, এই দুর্বলতাকে অনেকেই নারীত্বের বৈশিষ্ট্য মনে করেন।

তিনি বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি শুধু নিজের মতো করেই নেতৃত্ব দেব। নিউজিল্যান্ডে আপনি যদি নিজের মতো না হন, মানুষ সেটা ধরতে দেরি করে না।”

তিনি আরও বলেন, “কখনও কখনও আবেগ প্রকাশ না করাটা উপযুক্ত ছিল না কারণ সেটা ছিল ভুক্তভোগীদের সময়। আবার কিছু সময়ে মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া দেওয়াই সঠিক পথ।”

মা ও প্রধানমন্ত্রীএকসঙ্গে দুই ভূমিকা

আর্ডার্ন বিশ্বে দ্বিতীয় সরকারপ্রধান যিনি ক্ষমতায় থাকার সময় সন্তান জন্ম দেন। তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে নিজের গর্ভাবস্থার খবর জানতে একটি বন্ধুর বাথরুমে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন—সেই সময়ই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আলোচনা চলছিল। সন্তান জন্মের পর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নেন—সেখানে কখনও সন্তানের ডায়াপার পাল্টাচ্ছেন, কখনও বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। তার কয়েক বছর পর জাতিসংঘে নতুন মায়েদের জন্য একটি নার্সিং স্পেস চালু হয়।

এই অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতাগুলিই তাঁর মূল বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করে: সহানুভূতির সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়া মানবিক এবং কার্যকর।

নারী নেতাদের জন্য প্রত্যাশা?

আর্ডার্ন বলেন, “আমি নারী বা পুরুষ নির্বিশেষে বহু রাজনীতিকের মধ্যে সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব দেখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যেসব গুণ আমরা আমাদের সন্তানের মধ্যে চাই, যেমন দয়া, উদারতা, সাহস, সেগুলোকেই কেন আমরা নেতার মধ্যে দুর্বলতা মনে করি?”

নিজের জীবন কতটা প্রকাশ করবেন?

আর্ডার্ন বলেন, “আমার ওপর একটা দায়িত্ব ছিল দেখানোর যে, একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে মা হওয়াও সম্ভব। কিন্তু একইসঙ্গে আমি চেয়েছিলাম না যেন মনে হয় আমি সব একা করছি—ওয়ান্ডার ওম্যানের মতো নয়।”

তাঁর ছয় সপ্তাহ পর মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত অনেককে বিস্মিত করেছিল। যদিও তাঁর সরকার ছয় মাসের পিতৃত্ব ছুটির কথা বলেছিল, তিনি বলেন, “আমি ছয় মাস নিখোঁজ থাকতে পারি না। আমি নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী।”

তিনি বলেন, “শারীরিকভাবে আমি তখনও পুরোপুরি সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিলাম না। বুঝি না নারীরা কীভাবে আরও আগেই কাজে ফিরে যান।”

গেরিয়াট্রিক মাদার’ শব্দটি কেন?

বইয়ে তিনি “গেরিয়াট্রিক মাদার” শব্দটি উল্লেখ করে বলেন, “এই পরিভাষা বদলানোর সময় এসেছে। কেন না একজন মা যদি বয়সে একটু বড়ও হন, তাতে তিনি ‘seasoned’ হতে পারেন, কিন্তু ‘বৃদ্ধ’ বলা উচিত নয়।”

ফিরে আসার আভাস

এই আত্মজীবনী প্রকাশ এবং একটি প্রামাণ্যচিত্র (যার নাম Prime Minister)—যা এই মাসেই মুক্তি পাবে—সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, জাসিন্ডা আর্ডার্ন ধীরে ধীরে আবারও জনজীবনে ফিরে আসছেন। তবে এবার হয়তো এক নতুন রূপে—আরও মানবিক, আরও সরল এবং আরও কাছের একজন মানুষ হিসেবে।