আমেরিকার উচ্চশিক্ষা নীতির পরিবর্তনে নতুন সম্ভাবনা?
বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব এখন এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে—ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচ্চশিক্ষা নীতির কঠোরতা কি তাদের জন্য এক সুযোগ এনে দিয়েছে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়েছেন, সেগুলোর তহবিল বন্ধ করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকারও স্থগিত রেখেছেন, যার ফলে এবার মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
ভারত থেকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী বহু বছর ধরে আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছেন। বিখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটস অফ টেকনোলজি (আইআইটি)-এর শীর্ষ ১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি পড়তে যায় বিদেশে, প্রধানত আমেরিকায়। বর্তমানে আমেরিকায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভারতীয়।
কিন্তু এক গবেষণা বলছে, ট্রাম্পের নতুন নীতির কারণে আগামী শিক্ষাবর্ষে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের আবেদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এ সুযোগ ভারত চাইলে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধাপাচার রোধে কাজে লাগাতে পারে।
ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তাত্ত্বিকভাবে, ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতামূলক। হার্ভার্ডে ভর্তি হওয়া তুলনামূলক সহজ: যেখানে আমেরিকার আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হার ৩-৯ শতাংশ, সেখানে ভারতের নামী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি মাত্র ০.২ শতাংশ। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়-উপযোগী তরুণদের একটি বড় অংশই ভারতে বাস করে। পাশাপাশি ইংরেজি দক্ষতাও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের এগিয়ে রাখে।
কিন্তু বাস্তবতায় এখনো কোনো ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শীর্ষ ১০০-তে জায়গা করে নিতে পারেনি। চীন যেখানে মাত্র এক দশক আগেই এই তালিকায় ঢুকেছে, সেখানে এখন অনেক র্যাংকিং-এ সর্বোচ্চ সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও গবেষণার অভাব
ভারতের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থ। গত এক দশকে দেশটি জিডিপির মাত্র ৪.১ থেকে ৪.৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করেছে। চীনও একই অনুপাতে ব্যয় করলেও, তার মাথাপিছু আয় ভারতের পাঁচ গুণ। চীন সেই অর্থে গবেষণাখাতে উদার অনুদান, বিদেশফেরত গবেষকদের জন্য বোনাস ও সুবিধা দিয়ে বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান গড়ে তুলেছে। ভারত এখনও সেই পথে যেতে পারেনি।
গবেষণার স্বাধীনতার অভাব
ভারতের আরেক বড় সমস্যা হলো একাডেমিক স্বাধীনতার অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে পড়ানো হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনুদান কমিশনের কঠোর তদারকি চালু আছে। গবেষকরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন কিংবা বিদেশ সফরে যেতে চাইলে সরকারি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগও রাজনৈতিক প্রভাবাধীন।
২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘Scholars at Risk’ ও সুইডিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান V-Dem-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতের একাডেমিক স্বাধীনতার সূচক ১৯৪০-এর দশকের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে গেছে এবং দেশটি এখন ‘সম্পূর্ণভাবে সীমাবদ্ধ’ তালিকায়।
একজন ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যিনি বর্তমানে আমেরিকায় কাজ করছেন, বলেন—ভারতে তিনি যে সিলেবাস পড়াতেন, সেটি এখন তার দেশে পড়ালে গ্রেফতার হতে পারেন।
সংস্কারের চেষ্টা ও প্রতিবন্ধকতা
২০১৭ সালে “Institutions of Eminence” নামে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়, যাতে প্রতিশ্রুতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশি স্বায়ত্তশাসন ও অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট পাওয়া যায়নি। পরে ২০২০ সালের “জাতীয় শিক্ষা নীতি”-তে বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড ও উচ্চপদে সরকারের হস্তক্ষেপ কমাতে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই নীতির বাস্তবায়ন ধীর এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পড়েছে।
বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব অনেক রাজ্যের বিরোধিতার মুখে পড়েছে, যা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিতে পারে।
ব্যক্তিখাতই হতে পারে ভবিষ্যতের আশার আলো
ভারতের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উত্থানে। দুই দশক আগে যেখানে এর সংখ্যা ছিল ২০-এর নিচে, আজ তা দাঁড়িয়েছে ৪০০-র বেশি—যা মোট উচ্চশিক্ষার এক-চতুর্থাংশ।
বড় শিল্পগোষ্ঠীর বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি অধ্যাপকদেরও নিয়োগ দিচ্ছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ সৌমেন চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে—কারণ এগুলোতে অধিক স্বাধীনতা রয়েছে।
সরকারি নিয়োগব্যবস্থার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, কোটা ও বাধ্যতামূলক নীতিমালার বাইরেই এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে। যদি সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা দিয়ে সহায়তা করে, তাহলে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে উন্নতি করার সুযোগ থাকবে।