ভূমিকম্প নয়, আসল বিপর্যয় রাজনৈতিক
২০২৫ সালের মার্চ মাসে মিয়ানমারে ৭.৭ মাত্রার একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৩ হাজার ৭৪০ জন নিহত হয়। কিন্তু প্রকৃত বিপর্যয় এটি নয়। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটি এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের কাছাকাছি সাধারণ মানুষ নিহত, প্রায় ৩০ লাখ গৃহচ্যুত এবং ২০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। দেশটির অর্থনীতি ২০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে এবং তা এখন আগের অর্ধেকেরও কম।
এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমার পরিণত হয়েছে এক অপরাধতৎপরতার ঘাঁটিতে। মাদক উৎপাদন, মানব পাচার এবং ভয়াবহ স্ক্যাম ইন্ডাস্ট্রি এখন তুঙ্গে।
পশ্চিমা দৃষ্টি অন্যত্র, চীনের মনোযোগ সীমান্তে
পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে ইউক্রেন ও গাজার সংকটে ব্যস্ত, চীন ঠিকই প্রতিবেশী মিয়ানমারের এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়েছে। চীনের লক্ষ্য—সীমান্ত নিরাপদ রাখা, ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বাণিজ্যপথ রক্ষা, দেশটিতে চীনা বিনিয়োগ নিরাপদ রাখা, চীনা নাগরিকদের ওপর চালানো স্ক্যাম বন্ধ করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, পশ্চিমা প্রভাব ঠেকানো।
চীনের এই কৌশল সফল হয়েছে। শুরুতে সামরিক জান্তা ও প্রতিরোধ আন্দোলন উভয়েই চীনের প্রতি সন্দেহপ্রবণ ছিল, কিন্তু এখন কেউই চীনের বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিচ্ছে না।
কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু: পাইপলাইন ও চুক্তি
মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং পর্যন্ত ২৫০০ কিমি দীর্ঘ একটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইন অব্যাহতভাবে চালু রয়েছে। যুদ্ধরত সব পক্ষই এই পাইপলাইনকে অক্ষত রেখেছে। এতে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকছে।
তরুণদের প্রতিরোধ, জান্তার নির্মমতা
জান্তা-বিরোধী বিক্ষোভে যারা বেঁচে গেছেন, তারা দেশটির পার্বত্য সীমান্তে পালিয়ে যান এবং সেখানে জাতিগত সংখ্যালঘুদের হাতে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পান। এই তরুণ যোদ্ধাদের অধিকাংশই সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠীর। তারা এখন কেন্দ্রীয় শুষ্ক অঞ্চলে জান্তার বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে এবং নিজেদের স্কুল-হাসপাতাল পরিচালনা করছে। জান্তা বিমান হামলা ও নিধন অভিযানের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
জাতিগত বাহিনীর বিভক্তি: পশ্চিমমুখী বনাম চীনঘেঁষা
জাতিগত বাহিনীগুলো দুই ভাগে বিভক্ত—একদল পশ্চিমঘেঁষা, যারা ‘স্প্রিং রেভল্যুশন’-এর অংশ হিসেবে জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। অন্যদিকে, চীনঘেঁষা বাহিনীগুলো প্রাথমিকভাবে লড়াইয়ে নামেনি, বরং জান্তার সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে থেকেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনঘেঁষা ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ আকস্মিকভাবে শান ও রাখাইন রাজ্যে সেনা অবস্থানে হামলা চালায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা জান্তাকে ঐতিহাসিক পরাজয়ের স্বাদ দেয়। ধারণা করা হয়, চীনের সম্মতিতেই এই অভিযান হয় যাতে স্ক্যাম সেন্টারগুলো ধ্বংস হয়।
চীনের নিয়ন্ত্রণ: যখন দরকার তখন চেপে ধরা
ব্রাদারহুড তাদের লক্ষ্য অর্জনের পর চীন উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করায়। কিন্তু ২০২৪ সালের জুনে তারা যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে লাশিও শহর এবং সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ঘাঁটি দখল করে নেয়। অপর একটি বাহিনী মান্দালয়ের দিকে অগ্রসর হয়।
জান্তা পতনের আশঙ্কায় চীন এই বাহিনীর জল, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়, এমনকি এক নেতাকে অপহরণও করে। এতে বাধ্য হয়ে তারা পিছু হটে এবং এপ্রিল মাসে লাশিও ফেরত দেয়।
চীনের আসল ভয়: গণতান্ত্রিক মিয়ানমার
চীনের সবচেয়ে বড় ভয়—যদি গণতন্ত্রপন্থীরা ক্ষমতায় আসে, তবে দেশটি পশ্চিমা প্রভাবের ঘাঁটি হয়ে উঠবে। তাই চীন এমন গোষ্ঠীগুলোকেই শক্তি দিচ্ছে যারা পশ্চিমবিরোধী। একই সঙ্গে চীন হুমকি দিচ্ছে—যেসব জাতিগত বাহিনী চীনকে না জানিয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের সহায়তা করবে, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হবে।
পশ্চিমা সহায়তা নেই বললেই চলে
গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘ ২০২৪ সালে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাইলেও মাত্র ৩৯ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনোভাবে ১২১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ পেলেও ট্রাম্প প্রশাসনের USAID বন্ধ করার সিদ্ধান্তে সহায়তা আরও কমেছে।
চীনের পরিকল্পনা: নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ
চীন চাইছে ২০২৫ সালের শেষ দিকে মিয়ানমারে নির্বাচন হোক, যাতে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হন এবং সেনাবাহিনীর দায়িত্ব আরেকজনের হাতে তুলে দেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতি ছাড়া নির্বাচন হলে তা হবে একপ্রকার প্রহসন।
চীনের প্রভাব যতই প্রবল হোক, মিন অং হ্লাইংকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে পারবে না। বরং চীনের পছন্দ হলো—দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত বজায় থাকুক যাতে সে সব পক্ষের ওপর প্রভাব রাখতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার সংলাপ কৌশল
২০২৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী রেতনো মারসুদি চারটি প্রধান পক্ষকে জাকার্তায় আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘প্রক্সিমিটি টকস’ শুরু করেন। তারা আলাদা হোটেলে থেকে বার্তা চালাচালি করে। যদিও তারা মূল বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখায়নি, তবুও ভবিষ্যতের সমাধানে এটি একটি কার্যকর রূপরেখা হতে পারে।
মিয়ানমারের বিপর্যয় থেকে চীন সবচেয়ে বেশি লাভবান হলেও, এই লাভের ভিত্তি গড়া হয়েছে লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ওপর। স্থায়ী সমাধান চায় বলেই নয়, বরং চীন চায় পরিস্থিতি এমন থাকুক—যাতে সে সুবিধাভোগী হয়ে থাকতে পারে। মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই লাভ ও নৈতিকতার দ্বন্দ্বে কে জয়ী হয় তার ওপর।