মায়াওয়াডির অন্ধকার ফাঁদ
সিয়েরা লিওনের ক্রীড়াশিক্ষক স্যামুয়েল ফেসবুকে একটি বার্তা পান—থাইল্যান্ডে একই পেশায় কাজ করলে বর্তমান আয়ের দশগুণ পাওয়া যাবে। স্বপ্নের টানে ব্যাংককে পৌঁছে তিনি বুঝলেন, বাস্তবতা ভয়াবহ। সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারের মায়াওয়াডিতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে লোমহর্ষক নির্যাতনের পর অনলাইন-প্রতারণা কেন্দ্রে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দশ মাস ধরে কাঁটাতার, উঁচু দেয়াল ও সশস্ত্র প্রহরায় ঘেরা বিশাল কম্পাউন্ডে বন্দি থেকে তিনি ধনাঢ্য সিংগাপুরি নারী সেজে ই-বে-তে প্রতারণার দায়ে নিযুক্ত ছিলেন।
আংশিক মুক্তি, বিশাল অবরুদ্ধ জনপদ
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে মায়াওয়াডি এলাকার বিভিন্ন কম্পাউন্ড থেকে প্রায় ৭,০০০ জনকে মুক্ত করা হয়। তা সত্ত্বেও জাতিসংঘের হিসাবে মিয়ানমারজুড়ে এখনো অন্তত ১,২০,০০০ মানুষ এসব ‘স্ক্যাম সেন্টার’-এ আটকে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাংক ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের ধারণা, বিশ্বজুড়ে এই অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত জবরদস্তিমূলক ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মীর সংখ্যা ১৫ লক্ষের মতো—যা মাদকের অবৈধ বাজারকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত, আফ্রিকানদের ভোগান্তি
দু’মাসেরও বেশি ভয়ংকর বন্দিজীবন শেষ করে ৮ মে স্যামুয়েল অবশেষে ফ্রিটাউন ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু মায়াওয়াডিতে এখনো প্রায় ৪০০ মানুষ, অধিকাংশই ইথিওপিয়ার, আটকা। তাদের প্রত্যাবাসন থাইল্যান্ড-মিয়ানমার দূতাবাসের জটিল কাগজপত্রে আটকে থাকে—আফ্রিকার অনেক দেশের নিকটতম দূতাবাস তো বেইজিং বা টোকিওতে। অধিকাংশ সরকার ভ্রমণব্যয় দিতেও অপারগ। যারা রয়ে গেছেন, তারা কায়িন বর্ডার গার্ড ফোর্সের (বিজিএফ) নিয়ন্ত্রিত সামরিক শিবির বা পুরোনো স্ক্যাম কম্পাউন্ডে অল্প খাবার-পানিতে কষ্ট পাচ্ছেন; চিকিৎসার অভাবে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও মিলেছে।
প্রতারণা কারখানার অপ্রতিরোধ্য বিস্তার
থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের এনজিও গ্লোবাল অ্যাডভান্স প্রজেক্টসের জুদাহ টানা জানান, ভারত, ফিলিপাইনসহ নানা দেশের মানুষ এখন স্বেচ্ছায় এসব কম্পাউন্ডে কাজ নিতে আসছেন—জানেন যে কাজটি অনলাইন-ঠকবাজি। আগের মতো ব্যাংকক বিমানবন্দর থেকে মায়ে সট শহর হয়ে সহজে পার হওয়া যায় না; থাই কর্তৃপক্ষ পথ কঠোর করেছে। এখন ব্যাংকক থেকে মায়ে সট পর্যন্ত দশবারের মতো গাড়ি বদলে চক্রপথে যেতে হয়।
চীনের চাপ ও ‘দক্ষতা বাছাই’ কৌশল
চীনা নাগরিকদের উপস্থিতি সীমান্তে কমেছে। এর পেছনে বড় কারণ, জানুয়ারিতে জনপ্রিয় চীনা অভিনেতা ওয়াং শিং-কে মিয়ানমারের একটি স্ক্যাম কম্পাউন্ডে পাচারের খবরে চীনে তীব্র প্রতিবাদ জাগে। বেইজিংয়ের চাপেই স্থানীয় মিলিশিয়ারা ফেব্রুয়ারিতে স্যামুয়েলসহ অনেককে ছেড়ে দেয়। তবে অপরাধবিশ্লেষক জেকব সিমসের ভাষায়, এটি আসলে “দক্ষতাহীন নিচের ৫-১০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই”। পুরো অপরাধচক্র ভাঙতে হলে আরও বিস্তৃত ও স্থায়ী উদ্যোগ দরকার।
করণীয় ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা, থাই কর্তৃপক্ষ এবং আঞ্চলিক মিলিশিয়াদের লাভের অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা এই জাল ভাঙা সহজ নয়। বহুপাক্ষিক চাপ, কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ভুক্তভোগীদের দ্রুত উদ্ধার ও পুনর্বাসন এবং প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতারণার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে কড়া নিয়ন্ত্রণে আনাই হতে পারে একমাত্র পথ। না হলে ‘মায়াওয়াডি ব্লুজ’ অদূর ভবিষ্যতে আরও বহু স্যামুয়েলের স্বপ্ন ভেঙে দেবে।