পূর্ববর্তী শতকের পর স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মহাশক্তির প্রতিযোগিতা ২০১৭ সালের মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে আবার উচ্চকণ্ঠে ফিরে আসে। সেই কৌশলপত্রে চীন ও রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরে বলা হয়, তাদের সামলাতে ও পেছনে ফেলতেই ওয়াশিংটনের নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু ২০২৫-এ দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউস ফেরার মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই গত এক দশকের স্বীকৃত পথই বদলে দিলেন—প্রতিযোগিতার বদলে এবার লক্ষ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গেই বোঝাপড়া।
মহাশক্তি প্রতিযোগিতার যুগ: ২০১৭-২০২৪
• ২০১৭-এর ট্রাম্প প্রশাসন বলেছিল, “সবচেয়ে জরুরি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আন্তঃরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা।”
• ২০২১-এ জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে ভাষা বদলালেও সুর রাখলেন একই—চীনকে ‘আউট-কম্পিট’ আর রাশিয়াকে ‘দমানো’।
• ইউক্রেন যুদ্ধ, তাইওয়ানে চীনা চাপ ও চীন-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতাও ওই গল্পকে শক্ত করে তোলে।
ট্রাম্পের হঠাৎ মোড়: প্রতিযোগিতা থেকে কোল্যুশনে
• দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্প ইউক্রেনে দ্রুত সমাধান চান—রাশিয়ার বড় অংশ দখল মেনে নিয়েই হোক।
• চীনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ চলছে, তবু তিনি শি চিনপিং-এর সঙ্গে ‘ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে’ সমঝোতার আশায়।
• ইউরোপ, কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, পানামা ক্যানাল—মিত্রদের ওপরই চাপ বাড়িয়েছেন, যেন শক্তির প্রদর্শনী।
উনিশ শতক থেকে হোয়াইট হাউস
মহাশক্তিদের বোঝাপড়া করে বিশ্ব শাসনের ধারণা নতুন নয়। ১৮১৫-এর ‘কনসার্ট অব ইউরোপ’ অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, রুশ ও যুক্তরাজ্যকে এক টেবিলে বসিয়ে বিপ্লব দমনের বিধি বেঁধেছিল। ওই ব্যবস্থায় বিপ্লবী আন্দোলন ঠেকানো হলেও শেষ পর্যন্ত প্রুশিয়ার উত্থান ও ঔপনিবেশিক দৌড়ে তা ভেঙে পড়ে। ট্রাম্প এখন সেই মডেলই যেন আমেরিকান ভিন্নরূপে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন—একেক মহাশক্তি নিজ নিজ ‘স্ফিয়ার’ চালাবে, বাকিরা হস্তক্ষেপ করবে না।
নতুন প্রভাববলয় ভাগাভাগি
• রাশিয়াকে ইউক্রেনের অংশ দখলে ছেড়ে দিলে মস্কো যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্রদের হুমকি না দিক—এই মোদ্দা চিন্তা।
• চীনের হাতে তাইওয়ান গেলে বা ফিলিপাইনে মার্কিন সেনা কমানো হলে, বেইজিং দখলদারি বাড়াবে না—এমন বোঝাপড়ার ইঙ্গিত।
• বদলে ট্রাম্প কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, পানামায় নিজের কর্তৃত্ব দৃঢ় করতে চান।
কেন টেকসই নয় এই গোপন সমঝোতা
• স্পষ্ট সীমানা টানা ইতিহাসেও কঠিন ছিল; আজকের বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল ও জলবায়ু সঙ্কটে আরও জটিল।
• আদর্শিক ফারাক চাপা দেয়া গেলেও মিটে না—তাইওয়ান দখল বা গণতন্ত্র দমনে গণঅসন্তোষ বাড়বে।
• মধ্যশক্তিগুলি—ইউরোপ, জাপান, ভারত—নিজস্ব প্রভাব বাড়াচ্ছে, মহাশক্তির diktat সহজে মানবে না।
• ১৯ শতকের কনসার্ট শেষ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল; আজও একই ঝুঁকি।
সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা নাকি সংঘাত?
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বা জলবায়ু ইস্যুতে চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা জরুরি, কিন্তু কোল্যুশনের ভিত্তিতে নয়। নিয়মভিত্তিক, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামো ছাড়া মহাশক্তি সমঝোতা অল্পদিনেই অবিশ্বাস, সীমান্ত সংঘাত ও মধ্যশক্তির বিদ্রোহ ডেকে আনে। ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়—শক্তির গোপন ভাগাভাগি যতই আকর্ষণীয় হোক, শেষটা প্রায়শই অগ্নিপরীক্ষায় গিয়ে ঠেকে।