দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অচলাবস্থা চলছে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে। বহির্বিভাগে আংশিক চিকিৎসা সেবা চালু হলেও সংকট পুরোপুরি কাটেনি। গত ২৮শে মে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের সংঘর্ষ-মারামারির পর থেকেই হাসপাতালটিতে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ১৪ই জুন, শনিবার থেকে চিকিৎসা সেবা আবার চালু করা হবে।
অন্যদিকে, সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত না করে অথবা চিকিৎসার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল না ছাড়ার ঘোষণায় এখনো অনড় জুলাই অভ্যুত্থানে আহত হয়ে ওই হাসপাতালে চিকিৎসারতরা।
বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালটিতে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, সকাল থেকেই বিপুল রোগী চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগের সামনে লাইনে দাড়িয়েছেন। টিকিট কাউন্টার ও চিকিৎসকের রুমের সামনেও কয়েক’শ মানুষের ভীড়।
তবে, হাসপাতালের অন্য ফ্লোরগুলোতে ছিল শুনশান নীরবতা। দেশের সবচেয়ে বড় এই চক্ষু হাসপাতালের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো এদিনও ছিল একেবারেই ফাঁকা।
হাতেগোনা কয়েকজন রোগী ছিলেন ওয়ার্ড ও কেবিনগুলোতে। যাদের বেশিরভাগই ঈদের পরে এসেছেন জরুরি চিকিৎসাসেবা নিতে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত এখন পর্যন্ত চিকিৎসারত ৫৪ জনের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন তাদের জন্য বরাদ্দ বিশেষায়িত ওয়ার্ডে।
হাসপাতালের সামনে অবশ্য এদিনও মোতায়েন ছিলেন বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য।

চিকিৎসা শুরুর খবরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের বহির্বিভাগে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ
সকালেই হাসপাতালটির বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ান মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ডাক্তার দেখাতে পেরেছেন। “তেমন একটা চিকিৎসা দিল না ভাই, দেখলো না ভালো কইরা, উনি (চিকিৎসক) আমাকে একটা সিল দিয়ে একটা ড্রপ দিয়া দিলো”।
সাভার থেকে চিকিৎসা নিতে আসা একজন বিবিসি বাংলাকে জানান, ঈদের আগেও দুইদিন হাসপাতালে এসে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে গেছেন। আজ আবার এসেছেন চিকিৎসা নিতে। “অনেক ভিড় কতক্ষণ লাগে কে জানে,” বলছিলেন তিনি।
সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা চালু থাকলেও আজ অবশ্য সকাল ১১টা বাজতেই টিকিট দেয়া বন্ধ করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে বিপাকে পড়েন অনেকেই।
হাসপাতাল খোলার খবরে চিকিৎসা নিতে আসলেও চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাননি অনেক রোগী।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা ৫৩ বছর বয়সী শারমিন খাতুন বলছিলেন, “আমার অপারেশন হইছিল, আজকের ডেইটে ডাক্তার দেখানোর কথা, টিকিট নিতে আসছি সব বন্ধ”।
“সাড়ে এগারোটা বাজে আইসা দেখি বন্ধ কইরা দিছে, কাউন্টারে লোকই নাইকা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আমিনবাজার থেকে চিকিৎসা নিতে আসা জয়েজ মিয়া।
এদিকে, হাসপাতাল আংশিক চালু হলেও এখনো কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা।
বৃহস্পতিবারও নিরাপত্তা এবং সংকট কাটাতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে, প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের কাছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো ১২ জুন, বৃহস্পতিবার ছিল একেবারেই ফাঁকা
সমস্যার সমাধান হয়নি এখনো
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়েছিল যে কারণে, তার সমাধান হয়নি এখনো। হাসপাতালে চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গেও কর্তৃপক্ষের বিরোধ মেটেনি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসারতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৫ মে, দুপুরে ঠিক চিকিৎসা না পাওয়া ও অবহেলার অভিযোগ এনে বিষপান করেন সেখানে চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চারজন।
এ নিয়ে প্রাথমিক বিরোধ শুরু হলেও ২৮ মে, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামেন আহতরা।
একই দিনে নানা দাবিতে হাসপাতালের কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করলে সেখানে চিকিৎসারত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত এবং চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংঘর্ষ-মারামারির ঘটনা ঘটে।
এরপরই নিরাপত্তার দাবিতে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের সামনে মোতায়েন বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য
হাসপাতালের ওটি বয় সাজেদুল ইসলাম সবুজ বিবিসি বাংলাকে জানান, চিকিৎসাসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাসপাতালের স্টাফদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা।
“আমরা তাদেরকে ভালো সার্ভিস দিতে অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু তারপরও ছাত্ররা আমাদের ওপর হামলা করে মারধর করছে,” জানান মি. সবুজ।
হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় মোহাম্মদ শহীদ বিবিসি বাংলাকে জানান, শুরুতে হাসপাতালের পরিচালকের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা।
“ওরা (জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা) ফ্যামিলি সহকারে থাকতেছে, বউ-বাচ্চা নিয়া তারপরে থাকতেছে”।
“আমি শুক্রবারও ওদের জন্য ডিউটি কইরা গেছি, আমার খারপ লাগছে বলে আমি তাদের পাশে ছিলাম কিন্তু তারা যে এরকম করবো আমি এটা কল্পনাও করতে পারি নাই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন হাসপাতালের কর্মচারি মিজ রানি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, কর্মচারিরা যখন কর্মবিরতি পালন করছিল, তখন দুজন ছাত্র তাদের ওপর হামলা করে। “আমরা বোঝানোর চেষ্টা করলে তারা আমাদের ওপরও হামলা চালায়,” জানান তিনি।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের বেশিরভাগই চিকিৎসা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন
যদিও এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন হাসপাতালটিতে চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, শুরুতে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ১৪০ জন সেখানে ভর্তি হলেও বর্তমানে খাতাকলমে চিকিৎসাধীন আছেন ৫৪ জন।
হাসপাতালের যে ব্লকে তাদেরকে রাখা হয়েছে সেখানকার ওয়ার্ডগুলোতে বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ বেডই ফাঁকা। মোট ৫ জন রোগী চিকিৎসারত আছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ঠাঁকুরগায়ের মোহাম্মদ রাজু ইসলাম জানান, ঈদের ছুটিতে বাকিরা বাড়ি গেলেও শিগগিরই আবারো হাসপাতালে ফিরবেন।
এসময় হাসপাতালের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা অভিযোগ করেন মি. রাজু।
তিনি বলেন, সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া নিয়েই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মূলত বিরোধ তৈরী হয়েছে।
“আমাদের দাবি ছিল, হয় ভালো চিকিৎসা দেন না হয় অন্য কোথাও রেফার করে দেন। আপনারা যদি ট্রিটমেন্ট না দেন তাহলে আমরা গায়ে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন দিয়ে মরে যাব,” বলছিলেন তিনি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মারপিট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিচে কর্মসূচি পালনের সময় সাধারণ রোগীদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মচারিদের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি ঘটনা ঘটে।
এসময় “আমাদের দুই-চারজন ভাই ছিল নিচে, চা খাইতে গেছিল তাদেরও মারে, তাদেরকে মারতে মারতে একপর্যায়ে উপরে চলে আসে,” বলছিলেন মি. রাজু।
মূলত চিকিৎসায় অবহেলা, লাইন বাণিজ্য, বেড বাণিজ্যসহ হাসপাতালের নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলাতেই তাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেন মোহাম্মদ রাজু ইসলাম।
তিনি জানান, “হাসপাতালের নানা অনিয়মের বিষয়ে রোগীরা এসে আমাদের কাছে জানাতো,”।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর স্বারকলিপি দিয়েছেন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা
নিরাপত্তা ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটেনি
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আংশিক চালু হলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্যক্রম। এদিনও হাসপাতালের সামনে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
এদিন প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের কাছে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর স্বারকলিপি দিয়েছেন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা। যেখানে তারা সংকট নিরসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।
হাসপাতালে চিকিৎসকের উপিস্থিতিও ছিল বেশ কম। ৫০ জন চিকিৎসক থাকলেও বহির্বিভাগে মোট ২০ জন চিকিৎসক সেবা দিয়েছেন বলে জানান হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. জানে আলম মৃধা।
তিনি বলেন, “আমাদের ইচ্ছা, শনিবার থেকে পুরোপুরি চালু করবো কিন্তু কর্মকর্তা কর্মচারিদের দাবি তাদের নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করতে হবে”।
“আমরা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ বোধ করছি না। কাজেই এ নিয়ে একটা আশঙ্কা রয়েই গেছে,” বলছিলেন মি. মৃধা।
হাসপাতালটিতে চিকিৎসারত জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা নানা অনিয়ম করছে বলেও দাবি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে রিলিজ দেয়ার পরও হাসপাতালকে নিজেদের মতো ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ করে তারা।

আবারো কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয় কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় কথা জানিয়েছেন অনেকে
চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বলেন, “ওরা হসপিটালের কোনো নিয়মকানুন মানছে না, এটাই আমাদের কাছে প্রধান থ্রেট”।
হাসপাতালের একটি ব্লক আটকে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরা নিজেদের মতো ব্যবহার করছে। “যে যার মতো যাচ্ছে আসছে, একেবারে স্বাধীন মতো চলছে, এটা মোটেই কাম্য না” দাবি করেন মি. মৃধা।
এক্ষেত্রে আহতদের কেন অন্য হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জানে আলম মৃধা বলেন, “এখন যারা চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে রেফার করার মতো কোনো পেশেন্ট নাই”।
“যাদের প্রয়োজন ছিল তাদেরকে আগেই পাঠানো হয়েছে। এর চেয়ে উন্নত চিকিৎসা বিশ্বের কোথাও আর দেয়া সম্ভব না,” বলেও দাবি করেন হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।
ভর্তি থাকার পরও যে ৪৯ জন একটানা হাসপাতালে থাকছেন না তাদেরকে নিয়ম অনুযায়ী পলাতক দেখানো হবে বলেও জানান তিনি।
তবে “তারা যেতে না চাইলে আমাদের কিছু করার নেই”। পরবর্তী সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে বলেও জানান তিনি।
এর আগে, জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের বিষয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ বোর্ডও হাসপাতালে থাকা ৫৪ জনকে অ্যাসেসমেন্ট করার জন্য ডেকেছিল। তাদের মধ্যে ৩০ জন বোর্ডের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন।
এদিকে, চিকিৎসারত যে জুলাই আহতরা ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গেছেন শিগগিরই তারা আবারো হাসপাতালে ফিরবেন বলে জানান অন্য রোগীরা।
তখন আবারো কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী হয় কিনা এ নিয়ে শঙ্কায় কথা জানান, হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারি থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতরাও।
বিবিসি নিউজ বাংলা
সজল দাস 



















