১২:১৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

শিরোনাম: চীনের আবাসন বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

চীন দীর্ঘ সময় ধরে চলা আবাসন সংকটের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই সংকট দেশটির অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আশাবাদ জাগিয়েছে যে, পরিস্থিতির অবনতি থেমে গেছে এবং পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত হচ্ছে।

বাণিজ্যযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক চাপ

গত ছয় মাসে চীনের অর্থনীতি এক ধরনের ‘স্ট্রেস টেস্ট’ অতিক্রম করেছে। আমেরিকার সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে শুল্ক ইস্যুতে উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। মে ২৯ তারিখে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানান যে, আলোচনায় অগ্রগতি থমকে গেছে। এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চুক্তি লঙ্ঘনের দায় নিয়ে দোষারোপ চলতে থাকে।

যদিও বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো চলছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কিছু বিষয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন। প্রথমত, অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীল আছে — বেসরকারি খাতের অনুমান অনুযায়ী ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি থাকবে ৪-৫% এর মধ্যে। দ্বিতীয়ত, আবাসন খাতের দীর্ঘস্থায়ী সংকটের ইতি ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রেকর্ড দামে বিক্রিবাজারে আস্থা ফিরে আসছে

সাংহাইয়ের চাংনিং জেলায় একটি জার্মান স্টাইলে নির্মিত ভিলা মে ২৭ তারিখে ২৭০ মিলিয়ন ইউয়ানে (৩৮ মিলিয়ন ডলার) বিক্রি হয়। প্রতি বর্গমিটার ৫ লাখ ইউয়ান মূল্যে বিক্রিত এই বাড়িটি সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অন্যতম দামি রিয়েল এস্টেট লেনদেন হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই ঘটনাকে অনেকেই মনে করছেন, বাজারে ধনীদের আস্থা ফিরে আসার একটি বড় ইঙ্গিত।

অর্থনীতিতে আবাসনের ভূমিকা ও পতনের ধাক্কা

২০২০ সালের আগে চীনের মোট জিডিপির ২৫% আসত আবাসন খাত থেকে। বর্তমানে এই হার নেমে এসেছে ১৫% বা তারও কমে। এই খাতের ধস সাধারণ মানুষের সম্পদেও বড় প্রভাব ফেলেছে — ২০২১ সালে যেখানে ৮০% পারিবারিক সম্পদ ছিল রিয়েল এস্টেট ভিত্তিক, এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৭০%-এ। শত শত ডেভেলপার দেউলিয়া হয়েছে, কোটি কোটি টাকা ঋণ অনাদায়ী রয়ে গেছে।

বিক্রি কমলেও পতনের গতি মন্থর

২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে নতুন বাড়ি বিক্রি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৩% কমেছে। তুলনায় ২০২৪ সালে এই হার ছিল ১৭%। বাজারে পতন চললেও তা এখন ধীরে হচ্ছে। রেটিং সংস্থা S&P Global ধারণা করছে, এ বছর বিক্রি কিছুটা কমবে, তবে ভয়াবহ হারে নয়।

বাড়ির অতিরিক্ত সরবরাহ কমছে

চীনের “ফার্স্ট টিয়ার” শহরগুলো — বেইজিং, সাংহাই, গুয়াংজু ও শেনজেনে — অবিক্রিত ফ্ল্যাটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। ২০২৪ সালের জুলাইতে যেখানে এসব শহরে ইনভেন্টরি শেষ করতে ২০ মাস সময় লাগত, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা কমে এসেছে ১২.৫ মাসে। ২০১৬-১৯ সালের গড় ছিল ১০ মাস।

সাংহাইয়ের ঘুরে দাঁড়ানো

সাংহাইয়ের বাজারে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিমাসেই গত বছরের তুলনায় বেশি লেনদেন হয়েছে। কিছু নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে যেমন কে কয়টি বাড়ি কিনতে পারবে, কিন্তু উচ্চমূল্যের বাড়ি দ্রুত বিক্রি হচ্ছে। এক এজেন্ট ফাং বলেন, সাধারণ বাড়ির দামও এ বছর বাড়বে, তবে বিলাসবহুল বাড়ির দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ

এই পুনরুদ্ধারের অন্যতম কারণ হলো সময়। আইএমএফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহবাজারের ধস কাটিয়ে উঠতে সাধারণত চার বছর লাগে। ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে সরকার ডেভেলপারদের ঋণ সীমিত করা শুরু করে, আর বছরের শেষ নাগাদ বাজারে আতঙ্ক ছড়ায়।

এ ছাড়া স্থানীয় সরকারগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে অবিক্রিত জমি ও বাড়ি কিনতে, যেসব অর্থ এসেছে বিশেষ বন্ড বিক্রি থেকে। কেউ কেউ বাড়ি কেনার জন্য ভর্তুকিও দিচ্ছে। বস্তি পুনর্গঠনের এক প্রকল্প ১০ লাখ বাড়ির চাহিদা তৈরি করতে পারে। মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে, ফলে নতুন বাড়ি কেনার জন্য মর্টগেজও সস্তা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ এখনো আছে

জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে ৭০টি শহরে গৃহমূল্য গড়ে ২% হারে কমেছে। নতুন বিক্রয়, নির্মাণ কাজ শুরু ও সম্পন্ন হওয়া — তিনটি সূচকেই পতন দেখা গেছে। ম্যাকুয়েরির অর্থনীতিবিদ ল্যারি হু বলেন, পরিস্থিতি হয়তো আর খারাপ হচ্ছে না, তবে উন্নতির জন্য সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

ছোট শহরগুলোর দুরবস্থা

উদাহরণস্বরূপ, ওয়েনঝো শহরে বাড়ির দাম এখনও দ্রুত কমছে। এক রেস্তোরাঁ মালিক ঝোউ বলেন, সরকারি তথ্য বড় ছাড়ের কথা তুলে ধরে না — কিছু এলাকায় নতুন বাড়িতে ৫০% ছাড় চলছে। তিনি মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধকেই দায় দিচ্ছেন শিল্প খাতের মন্দার জন্য।

S&P-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রথম সারির শহরগুলোতে এ বছর বাড়ির দাম স্থির থাকবে, পরের বছর ১% বাড়তে পারে। কিন্তু তৃতীয় সারির শহর ও নিচে এই হার এ বছর ৪% এবং পরের বছর ২% হারে কমবে।

চীন তার ভয়াবহ আবাসন দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথে রয়েছে। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— যেন শুধু সাংহাইয়ের প্রাসাদসম বাড়িগুলোই নয়, দেশের অন্যান্য অংশের মানুষও যেন এই ঘুরে দাঁড়ানোর সুফল পায়।

শিরোনাম: চীনের আবাসন বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে

০৭:০০:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫

চীন দীর্ঘ সময় ধরে চলা আবাসন সংকটের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই সংকট দেশটির অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আশাবাদ জাগিয়েছে যে, পরিস্থিতির অবনতি থেমে গেছে এবং পুনরুদ্ধারের পথ প্রশস্ত হচ্ছে।

বাণিজ্যযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক চাপ

গত ছয় মাসে চীনের অর্থনীতি এক ধরনের ‘স্ট্রেস টেস্ট’ অতিক্রম করেছে। আমেরিকার সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে শুল্ক ইস্যুতে উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। মে ২৯ তারিখে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানান যে, আলোচনায় অগ্রগতি থমকে গেছে। এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চুক্তি লঙ্ঘনের দায় নিয়ে দোষারোপ চলতে থাকে।

যদিও বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো চলছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কিছু বিষয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন। প্রথমত, অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীল আছে — বেসরকারি খাতের অনুমান অনুযায়ী ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি থাকবে ৪-৫% এর মধ্যে। দ্বিতীয়ত, আবাসন খাতের দীর্ঘস্থায়ী সংকটের ইতি ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রেকর্ড দামে বিক্রিবাজারে আস্থা ফিরে আসছে

সাংহাইয়ের চাংনিং জেলায় একটি জার্মান স্টাইলে নির্মিত ভিলা মে ২৭ তারিখে ২৭০ মিলিয়ন ইউয়ানে (৩৮ মিলিয়ন ডলার) বিক্রি হয়। প্রতি বর্গমিটার ৫ লাখ ইউয়ান মূল্যে বিক্রিত এই বাড়িটি সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অন্যতম দামি রিয়েল এস্টেট লেনদেন হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই ঘটনাকে অনেকেই মনে করছেন, বাজারে ধনীদের আস্থা ফিরে আসার একটি বড় ইঙ্গিত।

অর্থনীতিতে আবাসনের ভূমিকা ও পতনের ধাক্কা

২০২০ সালের আগে চীনের মোট জিডিপির ২৫% আসত আবাসন খাত থেকে। বর্তমানে এই হার নেমে এসেছে ১৫% বা তারও কমে। এই খাতের ধস সাধারণ মানুষের সম্পদেও বড় প্রভাব ফেলেছে — ২০২১ সালে যেখানে ৮০% পারিবারিক সম্পদ ছিল রিয়েল এস্টেট ভিত্তিক, এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৭০%-এ। শত শত ডেভেলপার দেউলিয়া হয়েছে, কোটি কোটি টাকা ঋণ অনাদায়ী রয়ে গেছে।

বিক্রি কমলেও পতনের গতি মন্থর

২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে নতুন বাড়ি বিক্রি আগের বছরের তুলনায় মাত্র ৩% কমেছে। তুলনায় ২০২৪ সালে এই হার ছিল ১৭%। বাজারে পতন চললেও তা এখন ধীরে হচ্ছে। রেটিং সংস্থা S&P Global ধারণা করছে, এ বছর বিক্রি কিছুটা কমবে, তবে ভয়াবহ হারে নয়।

বাড়ির অতিরিক্ত সরবরাহ কমছে

চীনের “ফার্স্ট টিয়ার” শহরগুলো — বেইজিং, সাংহাই, গুয়াংজু ও শেনজেনে — অবিক্রিত ফ্ল্যাটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। ২০২৪ সালের জুলাইতে যেখানে এসব শহরে ইনভেন্টরি শেষ করতে ২০ মাস সময় লাগত, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা কমে এসেছে ১২.৫ মাসে। ২০১৬-১৯ সালের গড় ছিল ১০ মাস।

সাংহাইয়ের ঘুরে দাঁড়ানো

সাংহাইয়ের বাজারে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিমাসেই গত বছরের তুলনায় বেশি লেনদেন হয়েছে। কিছু নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে যেমন কে কয়টি বাড়ি কিনতে পারবে, কিন্তু উচ্চমূল্যের বাড়ি দ্রুত বিক্রি হচ্ছে। এক এজেন্ট ফাং বলেন, সাধারণ বাড়ির দামও এ বছর বাড়বে, তবে বিলাসবহুল বাড়ির দাম দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ

এই পুনরুদ্ধারের অন্যতম কারণ হলো সময়। আইএমএফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহবাজারের ধস কাটিয়ে উঠতে সাধারণত চার বছর লাগে। ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে সরকার ডেভেলপারদের ঋণ সীমিত করা শুরু করে, আর বছরের শেষ নাগাদ বাজারে আতঙ্ক ছড়ায়।

এ ছাড়া স্থানীয় সরকারগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে অবিক্রিত জমি ও বাড়ি কিনতে, যেসব অর্থ এসেছে বিশেষ বন্ড বিক্রি থেকে। কেউ কেউ বাড়ি কেনার জন্য ভর্তুকিও দিচ্ছে। বস্তি পুনর্গঠনের এক প্রকল্প ১০ লাখ বাড়ির চাহিদা তৈরি করতে পারে। মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে, ফলে নতুন বাড়ি কেনার জন্য মর্টগেজও সস্তা হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ এখনো আছে

জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে ৭০টি শহরে গৃহমূল্য গড়ে ২% হারে কমেছে। নতুন বিক্রয়, নির্মাণ কাজ শুরু ও সম্পন্ন হওয়া — তিনটি সূচকেই পতন দেখা গেছে। ম্যাকুয়েরির অর্থনীতিবিদ ল্যারি হু বলেন, পরিস্থিতি হয়তো আর খারাপ হচ্ছে না, তবে উন্নতির জন্য সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

ছোট শহরগুলোর দুরবস্থা

উদাহরণস্বরূপ, ওয়েনঝো শহরে বাড়ির দাম এখনও দ্রুত কমছে। এক রেস্তোরাঁ মালিক ঝোউ বলেন, সরকারি তথ্য বড় ছাড়ের কথা তুলে ধরে না — কিছু এলাকায় নতুন বাড়িতে ৫০% ছাড় চলছে। তিনি মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধকেই দায় দিচ্ছেন শিল্প খাতের মন্দার জন্য।

S&P-এর হিসাব অনুযায়ী, প্রথম সারির শহরগুলোতে এ বছর বাড়ির দাম স্থির থাকবে, পরের বছর ১% বাড়তে পারে। কিন্তু তৃতীয় সারির শহর ও নিচে এই হার এ বছর ৪% এবং পরের বছর ২% হারে কমবে।

চীন তার ভয়াবহ আবাসন দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথে রয়েছে। তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— যেন শুধু সাংহাইয়ের প্রাসাদসম বাড়িগুলোই নয়, দেশের অন্যান্য অংশের মানুষও যেন এই ঘুরে দাঁড়ানোর সুফল পায়।