অ্যাপলের নতুন কারখানায় রূপ নিচ্ছে ভারত
বর্তমানে ভারত হয়ে উঠছে অ্যাপলের অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। অ্যাপলের তৈরি প্রতি পাঁচটি আইফোনের মধ্যে প্রায় একটি ভারতে তৈরি হচ্ছে। ২০২৬ সালের মধ্যে অ্যাপল চায় যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া সব হ্যান্ডসেটই ভারতের কারখানায় তৈরি হোক। এই পরিবর্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্বস্তির কারণও হয়েছে। অ্যাপলের বড় সরবরাহকারী ফক্সকন সম্প্রতি ভারতে ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। শুধু ফক্সকন নয়, গত এক দশকে ভারতের ইলেকট্রনিক শিল্প প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে। যেসব কোম্পানি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়, তাদের জন্য ভারত দিনদিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
তবে এই প্রসার ঘটলেও ভারতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ঘাটতি স্পষ্ট। আইফোনের চিপ, ব্যাটারি, ক্যামেরা মডিউল—সবই এখনো প্রধানত চীনে তৈরি হয়। শুধু উৎপাদন নয়, চীনের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির শীর্ষ স্তরে উঠে গেছে। উদাহরণ হিসেবে ইয়এমটিসি (মেমরি চিপ) এবং সানি অপটিক্যাল (উন্নত ক্যামেরা মডিউল) কোম্পানির কথা বলা যায়। এর ফলে অ্যাপলের জন্য চীন শুধু উৎপাদনকেন্দ্র নয়, বরং উদ্ভাবনেরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
ভারতের উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকার চিত্র
ভারত বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা তুলনামূলকভাবে নগণ্য। গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ভারত বছরে ৭১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের তুলনায় এক-দশমাংশ মাত্র। দেশের মোট উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে তুলনায় ভারতের গবেষণা বিনিয়োগ ০.৭ শতাংশ, যেখানে আমেরিকায় ৩.৬ শতাংশ এবং চীনে ২.৪ শতাংশ।
বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংস্থার সূচকে উদ্ভাবনী সক্ষমতায় ভারত রয়েছে ৩৯তম স্থানে; চীন রয়েছে ১১তম এবং যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় স্থানে।
বিরোধপূর্ণ চিত্র: বিশাল টেক জনবল, কম উদ্ভাবন
ভারতে বিপুল প্রযুক্তিকর্মী রয়েছে। ওপেন সোর্স ডেভেলপারে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পরেই দ্বিতীয় এবং চীনের চেয়েও এগিয়ে। ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম-এর মতো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে রয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ওষুধে মৌলিক উদ্ভাবনে ভারতের অংশগ্রহণ নগণ্য। ভারতে বিশ্বমানের গবেষণা কম হয়। নেচার ইনডেক্স অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০০ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান নেই।
ভারতের তিনটি প্রধান সমস্যা
ভারতকে চীনের উচ্চপ্রযুক্তি উৎপাদনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হলে তিনটি প্রধান সমস্যায় সমাধান আনতে হবে:
১. বেসরকারি খাতের কম গবেষণা বিনিয়োগ
২. বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে উদ্ভাবনী আইডিয়া থেকে বাণিজ্যিক পণ্য তৈরির ঘাটতি
৩. উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণায় অল্প আগ্রহ
বেসরকারি খাতে গবেষণায় দুর্বলতা
উন্নত উদ্ভাবনী দেশগুলোতে গবেষণার বড় অংশ বেসরকারি খাত থেকে আসে। ভারতে এই অনুপাত এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২০০০ কর্পোরেট গবেষণা বিনিয়োগকারীর মধ্যে মাত্র ১৫টি ভারতীয়। তারা মিলে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে; একমাত্র গুগলই ৪৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। টাটা মোটরসের গবেষণা বিনিয়োগের বেশিরভাগই হয় তাদের ব্রিটিশ শাখা জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার থেকে।
উচ্চ মুনাফার প্রতিষ্ঠানগুলোও গবেষণায় কম ব্যয় করে। ভারতের সবচেয়ে লাভজনক পাঁচটি অ-আর্থিক কোম্পানি তাদের বিক্রয়ের মাত্র ০.৩ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করে। আমেরিকায় এই অনুপাত ৮.৮ শতাংশ, চীনে ২.১ শতাংশ। আইটি জায়ান্ট ইনফোসিস ১৯ বিলিয়ন ডলারের আয়ের মধ্যে গবেষণায় মাত্র ০.৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়।
সরকারি গবেষণায় গুণগত ঘাটতি
ভারতের একাডেমিকরা প্রকাশনার সংখ্যায় বিশ্বে তৃতীয় হলেও গুণমানে পিছিয়ে। এইচ-ইনডেক্স অনুযায়ী, ভারত রয়েছে ১৯তম স্থানে। সরকারি অর্থায়ন কাঠামোর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। গবেষণা অনুদান ব্যক্তি গবেষকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। ধীর নিয়োগপ্রক্রিয়া, ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা এবং ব্যবসায়িক প্রয়োগে দুর্বলতা বাধা হয়ে থাকে।
২০২৩ সালে ভারত সরকার ‘অনুসন্ধান ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (এএনআরএফ) চালু করেছে, যা আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের মডেল অনুসরণ করে গড়ে ওঠে। আগামী কয়েক বছরে এটি ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে। এর ৭০ শতাংশ বেসরকারি খাত ও দানশীল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আসার কথা। তবে অনেকে এ প্রকল্পের কাঠামো নিয়েও সন্দিহান।
স্টার্টআপ খাতে সীমাবদ্ধতা
বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সম্প্রতি উদ্যোক্তাদের প্রশ্ন তুলেছেন, তারা আইসক্রিম বানাতে চায় নাকি চিপস তৈরি করতে চায়। তার বক্তব্যে স্পষ্ট, দ্রুত লাভের অ্যাপ-ভিত্তিক ব্যবসার তুলনায় ভারতে গভীর প্রযুক্তি (ডিপ-টেক) উদ্ভাবন অপ্রতুল। ২০১৭ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের ডিপ-টেক স্টার্টআপগুলো মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে; যা মোট স্টার্টআপ বিনিয়োগের ৫ শতাংশেরও কম। একাই চীনের ডিপ-টেক স্টার্টআপগুলো ২০২৪ সালে ৬.৪ বিলিয়ন ডলার তুলেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি বড় আকারের পুঁজি পাওয়া কঠিন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগের অনেক তহবিল থাকলেও ২৫ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মাঝামাঝি বিনিয়োগের বড় ঘাটতি রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনে দ্বিতীয় জনপ্রিয় গন্তব্য হলেও দেশীয় উদ্ভাবনে তার প্রভাব খুবই সীমিত।
একটি সফল উদাহরণ: মহাকাশ গবেষণা
মহাকাশ গবেষণায় ভারত তুলনামূলকভাবে সফল। ২০২০ সালে বেসরকারি খাতের জন্য মহাকাশ খাত খুলে দেওয়া হয়। নতুন সংস্থা ‘ইন-স্পেস’ বেসরকারি কোম্পানিকে প্রযুক্তি ও অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। ইতিমধ্যে ৫০টিরও বেশি কোম্পানি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও মহাকাশভিত্তিক সেবায় অনুমোদন পেয়েছে।
তবে এই সাফল্যও বিশেষ ধরনের। সরকার এখানে স্পষ্ট লক্ষ্য ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করেছে। যদি ভারত শুধু অ্যাসেম্বলি লাইন না হয়ে উদ্ভাবনের কেন্দ্র হতে চায়, তবে একই ধরনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দক্ষতা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।