ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা এবং শীর্ষ বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে বড় ধরনের আঘাত হানা হয়েছে, তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু সমীকরণে নাটকীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামানোর প্রচেষ্টা চলছিল, কিন্তু ইসরায়েলের এই সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনেছে।
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ভয়াবহ ধাক্কা
ফরদোর ভূগর্ভস্থ সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র এবং পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন-এর মতো অতি সুরক্ষিত স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে ইসরায়েল প্রমাণ করেছে যে, তাদের গোয়েন্দা এবং সামরিক সক্ষমতা কতটা গভীর ও উন্নত। এসব স্থাপনাগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে কার্যক্রম অচল করা অত্যন্ত কঠিন হলেও ইসরায়েলের এয়ার ফোর্স ও মোসাদের সমন্বিত পরিকল্পনায় তা সম্ভব হয়েছে।
এখনও পরমাণু প্রকৌশলী আলি সালেহি জীবিত থাকলেও পুরো পরমাণু অবকাঠামো পুনর্গঠনের চেষ্টা করতে গেলে ইসরায়েল আবারো আঘাত হানবে বলে মনে করা হচ্ছে। এইভাবে এক প্রকার স্থায়ী নজরদারি ও সামরিক হুমকির মধ্যে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এখন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
শাসকগোষ্ঠীর আতঙ্ক ও রাজনৈতিক চাপে সরকার
ইরানের ইসলামি রেভল্যুশনারি গার্ডের তরুণ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে একের পর এক পরাজয়ের মুখ দেখছেন। ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইরানের সামরিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতা বারবার পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে। দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষ সরকারের পতনের পক্ষে থাকতে পারে এই ভয়ও দিন দিন বাড়ছে। ফলে জাতীয়তাবাদের ওপর ভরসা করে জনসমর্থন আদায় করাও এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের এই হামলায় ইরানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে — তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীরে মোসাদের প্রবেশ। একাধিক স্তরের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে মোসাদ ইরানের অপারেশনাল গোপনীয়তা প্রায় অকার্যকর করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক অবস্থান
অনুমান করা হচ্ছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো সরাসরি এই অভিযানে অনুমোদন দেননি, তবে এটিকে বাধাও দেননি। বরং এই হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে, যাতে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সক্ষমতা বাড়িয়ে মোসাদের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়।
এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) ওপর নির্ভর করছিল ইরানের পরমাণু অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে। কিন্তু ইসরায়েল নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করে অনেক এগিয়ে গেছে। পশ্চিমাদেরও এখন সেই পথ অনুসরণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
চীন-রাশিয়ার সমর্থন দুর্বল হবে
ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাশিয়া ও চীনকেও এখন নতুন করে তাদের কৌশল ভাবতে হবে। যদিও ইরান-বিরোধী অক্ষ এখনও টিকে থাকবে, তবে ইরানের দুর্বলতা বাড়ায় পুরো অক্ষের প্রভাব কমে আসবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
কূটনীতির ব্যর্থতা এবং গোয়েন্দা শ্রেষ্ঠত্ব
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বরাবরই মূলত গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের প্রকৃত অগ্রগতি ঠেকানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অনেকাংশে যুদ্ধের আশঙ্কা থেকেই পশ্চিমারা অনেক সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে।
ইসরায়েল সম্ভবত এমন তথ্য পেয়েছিল যা তাদের বুঝিয়ে দেয়, এটিই ছিল হামলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কারণ সময়ক্ষেপণ করলে ইরান হয়তো অপ্রতিরোধ্য অবস্থানে পৌঁছে যেত।
মোসাদের শক্তির নতুন প্রদর্শন
এই অভিযানের মাধ্যমে মোসাদ গোটা বিশ্বের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে নিজেদের শীর্ষ স্থানে নিয়ে গেছে। ইরানের গভীরে প্রবেশ করে এই অভিযান পরিচালনা করা শুধু ইসরায়েলের নয়, গোয়েন্দা ইতিহাসেরও এক বড় নজির হয়ে থাকবে।
এই মুহূর্তে ইরানের জন্য সবকিছুই আরও জটিল, ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই ইরানের পরমাণু স্বপ্নকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু সমীকরণে তাই এবার ইসরায়েলের চরম আঘাত এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।