নেপলসে আরেকটি ‘গোমোরা’ সিরিজ শুরু হতেই ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা
ইতালির নেপলস শহরের স্প্যানিশ কোয়ার্টারে চলতি বছরের মার্চে, গলির ভেতরে ক্রিসমাসের মূর্তি বিক্রির দোকানের ওপরে একটি ব্যানার ওড়ে উঠেছিল। সেখানে লেখা ছিল—“নেপলস আর তোমাকে সমর্থন করে না।” এই “তোমাকে” বলতে বোঝানো হচ্ছিল বহুল আলোচিত ইতালিয়ান টেলিভিশন অপরাধ-নাটক ‘গোমোরা’কে, যার প্রিক্যুয়েল ‘গোমোরা: অরিজিনস’ সম্প্রতি ওই এলাকাতেই চিত্রায়িত হচ্ছে।
২০০৬ সালে রবের্তো সাভিয়ানোর একই নামের বই থেকে শুরু হওয়া গোমোরা নামটি এখন যেন নেপলস শহরের অপরিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ২০০৮ সালের সিনেমা এবং ২০১৪ থেকে ৫ মৌসুমে চলা টিভি সিরিজের পরে এসেছে আরও দুটি চলচ্চিত্র—‘দ্য ইমমর্টাল’ ও ‘পিরানহাস’। এখন তৈরি হচ্ছে নব্বই দশকের কাহিনি অবলম্বনে ‘অরিজিনস’।
তবে নেপলসের বহু বাসিন্দা বলছেন, ‘গোমোরা’র মাধ্যমে শুধু শহরের অপরাধজগতকেই তুলে ধরা হচ্ছে। সেই একই কথার পুনরাবৃত্তিতে ক্লান্ত তারা।
চতুর্থ প্রজন্মের এক ন্যাটিভিটি দোকানের মালিক জেনারো ডি ভারজিলিও বলেন, “প্রথমটা করল, দ্বিতীয়টা করল, এবার শেষ হোক—বাস্তা!”
পর্যটনের উত্থান ও শহরের বদলে যাওয়ার গল্প
নেপলস একসময় বিদেশিদের কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিপজ্জনক শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে পর্যটনের উত্থান শহরটিকে বদলে দিচ্ছে। খাবার, ইতিহাস আর সূর্যালোকে ভরপুর এই শহরে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি ভ্রমণপ্রেমী ভিড় করছে। তবে যুব বেকারত্ব ও অপরাধের হার এখনো অনেক বেশি।
তবু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ইতিবাচক ছবিগুলো শহরের খারাপ ভাবমূর্তি কিছুটা পাল্টাতে সাহায্য করছে। তবু স্থানীয়দের অভিযোগ—গোমোরা আবার সেই পুরনো নেগেটিভ চিত্রকেই ফিরিয়ে আনছে।
ডেলিয়া ডি’আলেসান্দ্রো বলেন, “আমি আমার শহরকে ভালোবাসি। সূর্যাস্তে যখন নদীর পাড়ে হাঁটি, তখন আবেগে আপ্লুত হই। কিন্তু আমাদের নিয়ে শুধু খারাপ কথাই বলা হয় কেন?”
গোমোরা বনাম বাস্তবতা
নেপলসের স্প্যানিশ কোয়ার্টার এখন আর আগের মতো পকেটমারদের গলি নয়। সেখানে আজকাল পর্যটকদের ভিড়, বিখ্যাত পিজ্জার দোকান, আর আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা দিয়েগো মারাদোনার বিশাল একটি দেয়ালচিত্র।
তবে মাফিয়া পুরোপুরি চলে যায়নি। ক্যামোরা এখনো মাদক পাচার ও অর্থপাচারে জড়িত। তবে আগের মতো এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে না।
নেপলসের উপশহরগুলোতে এখনো রয়েছে শিক্ষার অভাব, তরুণদের সহিংসতা, এবং বেকারত্ব। স্কাম্পিয়া অঞ্চলের মেলিসা বাসি হাইস্কুলের শিক্ষক জেনারো ডে ক্রেসেনজো বলছেন, গোমোরা সিরিজ আর সেখানে চিত্রায়িত গল্পের কারণে তার শিক্ষার্থীরা একটি নেতিবাচক ছাপ নিয়ে বেড়ে উঠছে।
“আমার কিছু শিক্ষার্থী যখন বিদেশে যায়, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়—তুমি স্কাম্পিয়া থেকে? ওহ, ‘গোমোরা’!” —এই ক্লিশে ছবিকে তিনি বলছেন ‘অপরাধের দাগ’।
প্রধান শিক্ষক ডোমেনিকো মাজ্জেলা ডি বোসকো বলেন, “এটা সহজে লেগে যায়, কিন্তু মুছে ফেলা কঠিন।”
গোমোরার চিত্রনাট্য নিয়ে বিতর্ক
‘অরিজিনস’-এর প্রধান প্রযোজক রিকার্ডো তোজ্জি দাবি করেন, তাদের সিরিজে নেপলসের স্থানীয় নাট্যশিল্পীদের অংশগ্রহণ রয়েছে, যা ইতিবাচক দিক। তিনি বলেন, “কেউ ভাবেন না ক্যামোরা থাকার জন্য নেপলসে যাব না। বরং এই রূঢ় বাস্তবতা মানুষকে আকৃষ্ট করে। শুধু সুন্দর ছবি দেখানো বিরক্তিকর।”
‘অরিজিনস’-এর পরিচালক মার্কো ডি’আমোরে ইনস্টাগ্রামে নেপলসকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখেন, “এই অনন্য শহর আমাদের যে উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা।”
তবে বিতর্ক থেমে নেই। নেপলসের এক মুদি দোকানি চিরো নভেল্লি নিজের দোকানে একটি পোস্টার টানিয়ে দিয়েছেন, “তোমাদের সাবধান করছি, যারা আমাদের বাস্তবতাকে কলঙ্কিত করছে!”
গ্রাহক জুসেপ্পে ডি গ্রাজিয়া বলেন, “আগে যুবকেরা মাফিয়াদের ভয় পেত। এখন তারা তাদের অনুকরণ করতে চায়, ছাপিয়ে যেতে চায়।”
নেপলসের আত্মবিশ্বাস ও ভবিষ্যৎ
স্কাম্পিয়ার বাসিন্দা ও সংগীতশিল্পী দানিয়েলে সানজোনে ২০০৫ সালে একটি র্যাপ গান তৈরি করেছিলেন—‘আমি ক্যামোরা।’ এখন তিনি তার এলাকাকে দেখাতে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান—ইতিহাস আর কুসংস্কার ভেঙে।
তিনি বলেন, “আমি কেবল গোমোরার শুটিং লোকেশন দেখাতে চাই না। আমি জটিল বাস্তবতা ফেরানোর চেষ্টা করি, যেটা মিডিয়া অতিসরলীকরণ করে উপস্থাপন করে।”
নেপলসের ফিল্ম কমিশনের পরিচালক মাওরিজিও জেম্মা বলেন, “একটি পরিপক্ব সমাজকে অবশ্যই তার দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলার সাহস থাকতে হবে। আশা, একদিন এসব সমস্যার সমাধান হবে।”
নেপলস শুধু গোমোরা নয়। এই শহরের গল্প আরও অনেক বৈচিত্র্যে ভরা—তাকেও দেখা জরুরি।