সরকারী মহল, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, আর দেশের তারকাখচিত অভিনেতাদের দুর্দান্ত উপস্থিতিতে রায়হান রাফির নির্মাণে ‘তাণ্ডব ‘ রাজনীতিনির্ভর রিভেঞ্জ অ্যাকশন সিনেমা। রাজনীতির বেশ কিছু ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ‘তাণ্ডব ‘ । দর্শক হিসেবে এক মুহূর্তের জন্যও ধারণা করা কঠিন পরের দৃশ্যে কী আসবে। গল্পের মূল চরিত্র একজন সাধারণ মানুষ, যিনি পরিস্থিতির চাপে সময়োপযোগী ভিন্ন রূপ নেন । সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার এই যাত্রাই সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু।
গল্পে ‘চ্যানেল বাংলা’ টেলিভিশন চ্যানেলে আবহাওয়ার খবর পড়ছিলেন উপস্থাপক । এরপর শুরু হয় একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এর মধ্যেই ভেসে আসে গোলাগুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঙ্কি মাস্ক পরা একদল মানুষ চ্যানেলের সব কর্মীকে জিম্মি করে ফেলে। মুখোশধারীদের দলনেতা স্বাধীন লাইভ চলাকালীন গুলি করেন সেই মন্ত্রীকে। এরপর মুখোশ খুলে ক্যামেরার সামনে বলে ওঠেন, ‘চলুন, শো শুরু করা যাক।’ আর এভাবেই চমক দিয়ে শুরু হয় ‘তাণ্ডব’। এরপর তার সাথে হওয়া এক অন্যায়ের গল্প শোনায়। বন্দীশালায় তাকে বিচার বহির্ভূতভাবে আটকে রাখা হয়। এতে তার জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।

এরপর জানা যায়, স্বাধীন ছেলেটি আসলে স্বাধীন না, তার আসল নাম শীর্ষ সন্ত্রাসী মিখাইল । এ ঘটনায় নড়ে ওঠে প্রশাসন। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ, স্পেশাল ‘সোয়াট’ সবাই দ্রুত পরিস্থিতি সমাধান করতে ছুটে যায়। এরপর একের পর এক ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়।
সিনেমায় আলোচিত গান ‘লিচুর বাগান’ । আইটেম সং মনে হলেও এটি রোমান্টিক ও ক্লাসিকের সমন্বয়ে নির্মিত গান।
সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। আর শাকিব খানের প্রেমিকা নিশাতের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাবিলা নূর। এ ছবি দিয়েই বাণিজ্যিক সিনেমার নায়িকা হিসেবে সাবিলার অভিষেক হয়। শাকিবের সঙ্গে সাবিলার রসায়ন ভালোই জমেছিল, তবে পর্দায় দুজনের একসাথে উপস্থিতি খুবই কম। তবে এটা যে তার প্রথম সিনেমা, সেটা কেউ না বললে বোঝার উপায় নেই। একজন নবাগত সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে নয়, বরং পরিণত একজন শিল্পী হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরেছে। তার নাটক, টেলিফিল্ম, ওটিটি প্রতিটি কাজে এক ধরনের পরিশীলিত ছাপ থাকে। তবে তান্ডবের সাবিলা একেবারেই অন্যরকম । চেহারার অভিব্যক্তি, এক্সপ্রেশন, চোখে চোখে কথা বলার স্টাইল সবকিছুতেই যেন ছিল এক নতুন সাবিলা। গুণী সব অভিনেতা ও অভিনেত্রীর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করে যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাবিলা যে অভিনয় করেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

গল্পে স্বাধীন চরিত্রে শাকিব খান তবে শেষে জানান দেওয়া হয় শাকিব খানের নাম স্বাধীন নয় মিখাইল, নিশাতের চরিত্রে সাবিলা নূর, সাংবাদিক সায়রার চরিত্রে জয়া আহসান, বর্তমান আইজিপি চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রীর চরিত্রে ডা. এজাজ, সাবেক আইজিপি চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম, ধর্মমন্ত্রীর চরিত্রে আফজাল হোসেন, টেলিভিশন চ্যানেলটির মালিক হিসেবে ছিলেন গাজী রাকায়েত হোসেন এবং সোয়াট টিমের প্রধান হিসেবে পর্দায় ছিলেন এফ এস নাঈম ।
জয়ার চরিত্রটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সায়রা চরিত্রে জয়ার লুক, অভিনয়, টুইস্ট সব মিলে দুর্দান্ত । শুধুমাত্র সাংবাদিক নয় একজন ভাই হারা বোন হিসাবে ইমোশনাল দৃশ্য গুলোতে জয়ার অভিনয় খুবই সাবলীল লেগেছে । সিনেমার মূল নারী চরিত্র হিসেবে যদি কাউকে ধরতে হয়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে জয়া আহসান। সবদিক থেকেই জয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকাটি পালন করেছেন। দর্শকরা পুরো সিনেমাজুড়ে শাকিব খান এবং জয়ার দৃশ্যগুলো উপভোগ করেছেন।

সেই সাথে সবচেয়ে কম সময় পর্দায় এসেও হাততালি পেয়েছেন আফরান নিশো ও সিয়াম আহমেদ। বড়লোকের খারাপ পথে যাওয়া ছেলের চরিত্রে সিয়াম আহমেদ দুর্দান্ত করেছেন। আফরান নিশো পর্দায় ফিরে এসেছেন সুড়ঙ্গ সিনেমার মাসুদ হয়ে, হাতে ট্যাটু ছিল, সেখানে লেখা ময়না।
অন্যদিকে, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে মুক্তির প্রথম দিনেই সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড গড়ে রায়হান রাফীর সিনেমা। কিন্তু পাইরেসির শিকার হয় ‘তাণ্ডব’। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পুরো সিনেমাই ঝকঝকে প্রিন্টে দেখতে পায় দর্শক। জানা গেছে, সিনেমাটির প্রযোজক শাহরিয়ার করিম ভূঁইয়া (শাহরিয়ার শাকিল) বাদী হয়ে ঢাকার বনানী থানায় কপিরাইট আইনের মামলা দায়ের করেন। অবশেষে‘তাণ্ডব’ সিনেমা পাইরেসির মুলহোতা টিপু সুলতানকে অবৈধভাবে সম্পূর্ণ এইচডি সংস্করণ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

সৈনিক সিনেমা হলে ‘তাণ্ডব ‘ দেখতে আসেন সরকারি তিতুমীর কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী তারা সারাক্ষণ প্রতিবেদককে বলেন, সিনেমার শুরুটা বেশ উত্তেজনার ছিল। দু‘জন সমসাময়িক নায়কের ক্যামিও ছবিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। শেষের এক মিনিটের ক্যামিওতে ক্লাইমেক্সের আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে আফরান নিশো।
সিনেমা দেখতে আসা শিবলী আহম্মেদ সুজন আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, কয়েক বছর আগেও আমরা চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ হতাশা প্রকাশ করে এসেছি। এখন সে পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করেছে। ভালো কিছু প্রোডাকশন কাজ শুরু করার পর বড় বাজেটের ছবি আসছে। ঈদের বাজারে এর প্রভাব বড়ভাবেই পড়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে পাইরেসির শিকার হয় ‘তাণ্ডব’। গত ঈদেও ‘বরবাদ’ ও ‘দাগি’ পাইরেসির কবলে পড়েছিল। মুক্তির অল্প দিনের মাথায়ই সিনেমার এইচডি ভার্সন অনলাইনে পাওয়া যায়। এভাবে চললে সত্যি বলতে সামনের দিন গুলোতে কেউ এতো বড় বাজেটের কাজ করতে চাইবে না। আর আবারো বাংলাদেশের এই শিল্পের অবস্থা দিন দিন পতনের দিকে চলে যাবে।

সারাক্ষণ প্রতিবেদককে ফয়সাল বলেন, রায়হান রাফি বাংলা সিনেমার একটা আলোচনার জগৎতৈরি করতে যাচ্ছেন। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তাণ্ডবে শাকিব সেরাটাই দিয়েছেন। শাকিবের এরকম সিনেমা আরও অনেক আগেই করা উচিৎ ছিলো।
রায়হান নামের এক দর্শক বলেন, অনেকেই বলতে পারেন সাবিলার সঙ্গে শাকিবকে মানায়নি। কিন্তু সিনেমা দেখার পর মনে হবে রাফি ঠিকই করেছেন সাবিলাকে নিয়ে। সিনেমার প্রথমার্ধেক বোরিং ফিল হলে শেষের ৩০ মিনিটে পয়সা উসুল মনে হবে।
উল্লেখ্য, সিনেমার শেষ দৃশ্যে আফরান নিশোর ক্যামিও ছিল নজরকাড়া। পর্দায় এসেই নিশো বলে ওঠেন, “মিখাইল…; ওইটা আমার টাকা, আমার টাকা কেউ নিতে পারবো না। জায়গায় জায়গায় ছ্যাঁদা কইরা দিবো। ঘুমাইতে পারবি না…! আমি মাসুদ ; সুড়ঙ্গ মাসুদ।” এতেই বোঝা যাচ্ছে পরবর্তীতে মিখাইলের সঙ্গে টক্কর হবে মাসুদের ।