এরই মধ্যে ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে ইসরায়েল–ইরান পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের কাছে ‘নিয়মহীন বা শর্তহীন সমর্পণ’ দাবি করেছেন, আর ওয়াশিংটন অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে পেন্টাগন। ইসরায়েল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে-পড়া নিজ নাগরিকদের আকাশপথে ফিরিয়ে আনার অভিযান শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশভরে ধোঁয়া, আতঙ্ক এবং কূটনৈতিক হুমকির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক তেলবাজারও উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা
হোয়াইট হাউস সূত্র জানায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মঙ্গলবার সত্য সামাজিক মাধ্যমে (ট্রুথ সোশ্যাল) ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ‘এখনই’ না ভাবলেও, “ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে”—এমন বার্তা দিয়েছেন। একই পোস্টে তিনি ‘UNCONDITIONAL SURRENDER!’ লিখে তেহরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এ সময় মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর মধ্যপ্রাচ্যে F-16, F-22 ও F-35 যুদ্ধবিমান পাঠানো এবং আগে পাঠানো বহরগুলোর মিশন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানায়, যেগুলো মূলত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে ব্যবহৃত হবে।
ইসরায়েল–ইরান পাল্টা হামলা
মঙ্গলবার গভীর রাতে ও বুধবার ভোরে ইরান তেল আবিবকে লক্ষ্য করে দুই দফা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে; অন্তত কয়েকটি আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুলি করে নামায়। এর পাল্টায় ইসরায়েলি বিমান বাহিনী তেহরানের উপকণ্ঠের খোজির মিসাইল কমপ্লেক্স, বিপ্লবী গার্ডস-সংশ্লিষ্ট একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সামরিক ঘাঁটিতে প্রায় ৫০টি জঙ্গি বিমানের সাহায্যে ২০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করে। ইরানের জাতিসংঘ দূত আলি বাহরাইনি জেনেভায় বলেছেন, “পরমাণু স্থাপনা টার্গেট করা মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।” তিনি কড়া প্রতিক্রিয়া জানানোর হুমকিও দিয়েছেন।
উপসাগরে উত্তপ্ত আবহ
ইরানের সাবেক অর্থমন্ত্রী এহসান খান্দুজি তেলবন্দর হরমুজ প্রণালি দিয়ে ট্যাঙ্কার ও এলএনজি জাহাজ চলাচল কেবল ইরানের অনুমতিতে চালু রাখার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এক দিন দেরি মানেই দেশের ভেতর যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা।” এই ঘোষণায় বিশ্ব তেলবাজারে অস্থিরতা বাড়ে, কারণ কাতার–ইরানের দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে হামলার খবর মিলেছে।
বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক কার্যক্রম
ইসরায়েল বুধবার থেকে ‘সেইফ রিটার্ন’ নামের ধাপে-ধাপে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। প্রথম ফ্লাইটে সাইপ্রাসের লারনাকা থেকে এল আল বিমানে দেশটির নাগরিকেরা তেল আবিবে পৌঁছান। রোম, মিলান, প্যারিস ও অ্যাথেন্স থেকেও বিশেষ ফ্লাইটের সূচি চূড়ান্ত হচ্ছে। তা ছাড়া আর্কিয়া ও ইসরায়ারের এয়ারলাইন্সও এই মিশনে যুক্ত হয়েছে।
চীন ইতিমধ্যে তুর্কমেনিস্তান, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানে স্থল ও বাস রুটে নিজ নাগরিকদের সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বেইজিং বলছে, ৭০০-র বেশি নাগরিক নিরাপদ স্থানে পৌঁছেছেন; আরও হাজারখানেক পথে রয়েছেন। বেশির ভাগই চীনের তেল-গ্যাস প্রকল্পে কর্মরত প্রকৌশলী।
গাজায় মানবিক বিপর্যয়
গাজার দক্ষিণাঞ্চল খান ইউনুসে সোমবার ত্রাণের জন্য ভিড় করা মানুষদের ওপর ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক শেল নিক্ষেপ করলে অন্তত ৫৯ জন নিহত ও ২২১ জন আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় চিকিৎসকেরা জানান। ক্ষুধার্ত জনগণ সাহায্যের ট্রাকে ভিড় করলে এই হামলা চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গুলি ছোড়ার কথা স্বীকার করে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে।
পরবর্তী সম্ভাব্য দৃশ্যপট
- ইসরায়েল দাবি করেছে, “ইরানের আকাশসীমায় নিয়ন্ত্রণ”প্রতিষ্ঠা করেছে এবং পরবর্তী দিনে হামলা আরও বাড়াতে চায়।
• ট্রাম্প প্রশাসন আন্তরিকভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলাসহ অংশগ্রহণের নানা বিকল্প বিবেচনা করছে।
• তেহরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়ালে ‘দ্বিধাহীন’ পাল্টাঘাত আসবে।
• হরমুজ প্রণালি ও দক্ষিণ পার্সে আঘাত চলতে থাকলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি দামে বড় উত্থান হতে পারে।
কূটনৈতিক তৎপরতা, সামরিক পাল্টাপাল্টি ও মানবিক বিপর্যয়ের ঘূর্ণি—সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প-নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা, ইরানের প্রতিশোধ-প্রতিজ্ঞা এবং ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক কৌশল মিলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে—তা নির্ভর করছে পরবর্তী কয়েক দিনের কূটনৈতিক সমঝোতা ও সামরিক পদক্ষেপের ওপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র উদ্বেগ সত্ত্বেও আপাতত শান্তির আভাস নেই; বরং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিসরে সংঘাতের ঢেউ ফুলে-ফেঁপে ওঠার আশঙ্কাই প্রবল।