ইসরায়েল-ইরানের চলমান বিমানযুদ্ধের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জরুরি পদক্ষেপ নিচ্ছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন তাদের নাগরিকদের সরিয়ে আনার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা শুরু করেছে।
মালয়েশিয়ার হুঁশিয়ারি ও পদক্ষেপ
মালয়েশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী ফাহমি ফাদজিল বুধবার জানিয়েছেন, ইরানে অবস্থানরত সব মালয়েশীয় নাগরিককে শুক্রবারের মধ্যে সরিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে। যদিও সেখানে মালয়েশীয়ের সংখ্যা সীমিত, তবু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে—“পরিস্থিতি খুব দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং তা হঠাৎ আরও খারাপ হতে পারে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “ইরানে অবস্থানরত সব মালয়েশীয় নাগরিককে দ্রুত যেকোনো উপায়ে দেশটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য জোরালোভাবে আহ্বান জানানো হচ্ছে।” উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ানদের জন্য ইসরায়েল ভ্রমণ নিষিদ্ধ, কারণ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
থাইল্যান্ডের প্রস্তুতি: ৪০ হাজার কর্মী ফেরানোর উদ্যোগ
থাই সরকারের মুখপাত্র জিরায়ু হোউংসাব মঙ্গলবার জানান, ইসরায়েলে কর্মরত প্রায় ৪০ হাজার থাই শ্রমিক ও ইরানে থাকা আরও ৩০০ জন নাগরিককে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে বিমান প্রস্তুত রাখতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে জানুয়ারিতে হামাসের হাতে অপহৃত পাঁচজন থাই কৃষিশ্রমিক গাজা থেকে মুক্তি পান। অক্টোবর ২০২৩-এর হামলায় ৫০ জনের বেশি থাই নাগরিক নিহত হন, যাঁদের অধিকাংশই ইসরায়েলের খামারে কর্মরত ছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের অবস্থা
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইরানে তাদের ৩৮৬ জন ও ইসরায়েলে ১৯৪ জন নাগরিক রয়েছেন। এখনও কোনো ইন্দোনেশীয় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও অন্তত ৫০ জন পর্যটক ইসরায়েল, জর্ডান ও ইরানে আটকে আছেন, কারণ সংঘর্ষ অঞ্চলের আকাশপথ বন্ধ। তাঁদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা হবে, সে বিষয়ে সরকার এখনো স্পষ্ট তথ্য দেয়নি।
ফিলিপাইনের দুশ্চিন্তা
ইসরায়েলে অবস্থিত ফিলিপিন দূতাবাস জানিয়েছে, সেখানে ৩০ হাজার ফিলিপিনোর মধ্যে প্রায় ১৫০ জন দেশে ফিরতে ইচ্ছুক। তবে অনেকেই গৃহকর্মী ও নার্স হিসেবে কাজের দায়িত্বের কারণে নিয়োজকদের ছেড়ে যেতে পারছেন না।
ইরানে প্রায় ১,১৮০ জন ফিলিপিনো রয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই ইরানি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে যুক্ত। তাঁদের সতর্ক থাকতে ও জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত রওনা হতে “গো-ব্যাগ” প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের অবস্থা
গত শুক্রবার ইসরায়েল ইরানের ওপর আক্রমণ শুরু করে, যার লক্ষ্য ছিল তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নক্ষমতা ধ্বংস করা। পাল্টা হামলায় ইরান তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, যাতে ২৪ জন বেসামরিক ইসরায়েলি নিহত হন।
এখন পর্যন্ত তেহরানে ইসরায়েলি আঘাতে ২২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, বেশির ভাগই সাধারণ নাগরিক। ইসরায়েলেও পাল্টা হামলায় কয়েক ডজন প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “আমেরিকার ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।” নিজের সোশ্যাল মিডিয়া Truth Social-এ তিনি “UNCONDITIONAL SURRENDER!” শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়ে জানান, ইরানের নেতাকে “এখনই হত্যা করার কোনো পরিকল্পনা নেই, তবে সময় ফুরিয়ে আসছে।”
মার্কিন সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান এবং একটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেছে। ইউরোপের ঘাঁটিগুলোতে পাঠানো হয়েছে জ্বালানি সরবরাহকারী বিমান।
আঞ্চলিক সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংঘর্ষ বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হলে বিশ্ব জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় বড় ধাক্কা লাগতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অভিবাসী শ্রমিক, কূটনীতি ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বের নিরাপত্তা ও অভিবাসী জনগণের জীবনেও গুরুতর প্রভাব ফেলছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ইতোমধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, তবে সংকট কতদূর গড়াবে, তা এখনও অনিশ্চিত।