ইসলামাবাদ – ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে একদিকে ইসলামী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং অন্যদিকে ইরান সীমান্ত বন্ধ করে সংঘাতের প্রভাব ঠেকানোর দ্বিধায় দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান।
গত শুক্রবার, যখন ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালায়, তখন থেকেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তিনি ইরান, তুরস্ক, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং এই অঞ্চলের ক্রমাবনতি পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দার ইসরায়েলি হামলাকে “অন্যায্য” বলে অভিহিত করেন।
ইরানের প্রতি সমর্থনের প্রকাশ আরও গভীর হয়েছে। মঙ্গলবার পাকিস্তান ২০টি আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানায়।
শনিবার, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-কে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “ইসরায়েলের আগ্রাসন চলতে থাকলে কোনো মুসলিম দেশই নিরাপদ নয়।”
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের নেতৃত্বে ইসলামি দেশগুলোকে কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়।
ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের গবেষক উমর করিম বলেন, “এটি মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। কিছু কূটনৈতিক তৎপরতা হতে পারে, OIC হয়তো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা বার্তা জারি করবে, তবে বেশিরভাগ আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিবেচনায় রাজনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
এই মতের সঙ্গে একমত জাহিদ শাহাব আহমেদ, যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বলেন, “মুসলিম বিশ্বের গভীর বিভাজন এবং OIC-এর সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনায়, পাকিস্তান নেতৃত্বাধীন কোনো বৃহৎ বা সমন্বিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রতীকী বিবৃতি বা মধ্যস্থতার বাইরে বাস্তব ফলাফল বয়ে আনবে না।”
যদিও পাকিস্তান কূটনীতির মাধ্যমে ইরানকে সমর্থন জানাতে সচেষ্ট, কিন্তু ইসলামাবাদের জন্য নতুন উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য মোহসেন রেজায়ির একটি ভিডিও, যেটি সোমবার প্রকাশ পায়। তাতে দাবি করা হয়, যদি ইসরায়েল তেহরানে পারমাণবিক বোমা ফেলে, তাহলে পাকিস্তানও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
সোমবার সংসদে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দার বলেন, “এটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ও মিথ্যা খবর। আমাদের পক্ষ থেকে এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি – এটি মনগড়া।”
পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসঙ্গ ছাড়াও, বিশ্লেষকরা মনে করেন পাকিস্তান এই সংঘাতে সামরিকভাবে জড়াতে আগ্রহী নয়।
“ইরানকে সামরিকভাবে সহায়তা করা মানে সরাসরি ইসরায়েলের নিশানায় পড়া। পাকিস্তানের পক্ষে এটি সম্ভব নয়, কারণ পূর্ব সীমান্তে ভারতের মতো শত্রু রাষ্ট্র আগে থেকেই বিদ্যমান,” বলেন করিম।
আরেকটি বড় উদ্বেগ ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত, যেটি গোল্ডস্মিড লাইন নামে পরিচিত। এটি ১৮৭০-এর দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাধ্যমে চিহ্নিত হয় এবং এটি বেলুচ জনগোষ্ঠীকে দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইরান অভিযোগ করেছে যে ইসলামপন্থী জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকে তাদের দেশে হামলা চালায়, আবার পাকিস্তানও বলেছে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইরান থেকে হামলা করে। এর জের ধরে গত বছর জানুয়ারিতে দুই দেশ একে অপরের ভূখণ্ডে সীমান্ত পার হয়ে হামলা চালায়।
“ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পটভূমিতে, পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ বেলুচ জঙ্গি গোষ্ঠী এবং ইরানের জাতিগত-ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের সুযোগ হিসেবে এটি কাজে লাগাতে পারে,” বলেন ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের গবেষক ইমতিয়াজ বেলুচ। “তারা নিজেদের এমন কৌশলগত শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে যারা উভয় দেশকে অস্থির করে তুলতে সক্ষম এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।”
ইসরায়েলের লাগাতার বিমান হামলায় ইরানের শহরগুলো এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতির মুখে দেশটির মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। কূটনৈতিকভাবে ইরানকে সমর্থন জানালেও পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ইরানি নাগরিককে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেয়নি। কেবল ইরানে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ফিরতে দেওয়া হচ্ছে। এই দ্বৈত অবস্থান পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কারণেই বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসলামি বিশ্ব এখন দুই ভাগে বিভক্ত – সুন্নি ও শিয়া। সৌদি আরব সুন্নি মুসলিমদের কেন্দ্র হিসেবে, আর ইরান শিয়া মুসলিমদের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। পাকিস্তান একটি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও, এখানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিয়া জনসংখ্যা বাস করে। ফলে ইরানের পর পাকিস্তানই শিয়া ইসলামের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
“পাকিস্তানের সমাজের কিছু অংশ সরকারের ওপর ইরানকে সমর্থন জানাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আরও বাড়তে পারে,” বলেন করিম।
আহমেদের মতে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে। তিনি বলেন, “পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্ক পারস্পরিক সন্দেহ এবং মাঝে মাঝে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে চলে, যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজন, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক সব সময়ই বাধা হিসেবে কাজ করেছে।”