০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ইন্দোনেশিয়ায় আগ্নেয়গিরির ছায়ায় জীবনযাপন

আগ্নেয়গিরির দেশ ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ বাস করে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির একেবারে আসেপাশে। এই ভূখণ্ডে রয়েছে প্রায় ১৩০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি—বিশ্বে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে অনেকগুলোই মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি।

আগ্নেয়গিরির ভয়াবহতা ও মানুষের সহাবস্থান

২০১৭ সালে বালির মাউন্ট আগুং-এর অগ্নুৎপাতের সময় প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়েছিল। ফটোগ্রাফার পুতু সায়োগা তখন থেকেই আগ্নেয়গিরির আসেপাশে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর ভাষায়, ‘‘মানুষগুলো অদ্ভুত রকম শান্ত। যেন আগ্নেয়গিরি তাঁদের জীবনের অঙ্গ।’’

তিনি আগুং থেকে শুরু করে জাভা, সুমাত্রা ও মালুকু দ্বীপের একাধিক আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। এসব মানুষের কাছে আগ্নেয়গিরি শুধু বিপদের উৎস নয়, বরং একধরনের ঐশ্বরিক শক্তি, যাকে ঘিরে চলে ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস ও জীবনধারণ।

বিপদের মাঝেও মানিয়ে নেওয়া

অনেকেই আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পর্কে সচেতন হলেও আতঙ্কে ভোগে না। বরং তারা রীতিমতো উৎসবের মতো করে আগ্নেয়গিরিকে পূজা করে। যেমন, জাভার তেঙ্গেরিজ জনগোষ্ঠী প্রতিবছর কাসাদা উৎসবে চাল, ফল, পশু ইত্যাদি আগ্নেয়গিরির মুখে উৎসর্গ করে। এটি তাদের বিশ্বাসেরই প্রতিফলন।

গবেষকরা বলছেন, এই মানসিকতা গড়ে উঠেছে কারণ এসব অঞ্চলে আগ্নেয়গিরির কোলঘেঁষে বসবাস ও কৃষিকাজ এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ে জমি হয় খুবই উর্বর, যা কৃষির জন্য আশীর্বাদ। ফলে অনেক সময় মানুষ জানে ঝুঁকি আছে, তবুও ফেলে যেতে চায় না জমি, গরু, ঘরবাড়ি।

ভয়াবহ ঘটনাবলি: সিনাবুং ও মেরাপি

সুমাত্রার সিনাবুং আগ্নেয়গিরি ২০১০ সালে ৪০০ বছর পর হঠাৎ করে অগ্নুৎপাত শুরু করে এবং ২০১৩ থেকে এখনো সক্রিয়। গবেষক গ্যাভিন সুলিভান ও সাউত সাগালা অগ্নুৎপাতের ঠিক আগে সেখানে ছিলেন। আগ্নেয়গিরি থেকে আগুনের ধোঁয়া এবং গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও স্থানীয়রা ছিলেন অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত।

এদিকে, ২০১০ সালে মাউন্ট মেরাপির অগ্নুৎপাত ২৭০ জন মানুষের প্রাণ নেয় এবং হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করে। অথচ এর আশেপাশে আজও এক মিলিয়নের বেশি মানুষ বসবাস করে।

কেন মানুষ যায় না অন্যত্র?

২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ায় মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নয়, বরং গড় তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের কারণে অন্য প্রদেশে স্থানান্তরিত হয়। আগ্নেয়গিরির মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত মানুষের স্থায়ী স্থানান্তরের প্রধান কারণ হয় না।

এই গবেষণা ইঙ্গিত করে, যেসব পরিবার আগ্নেয়গিরির কারণে স্থানত্যাগ করে, তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ফিরে আসে। মূল কারণ—জমি, গরু ও কৃষিকাজ। ইন্দোনেশিয়ার রেড ক্রসের মুখপাত্র আহমাদ হুসেইন বলেন, ‘‘মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময়ও গরুর কথা ভাবে। গরু না খেয়ে মরলে দায়িত্ব নেবে কে?’’

জীবিকার ঝুঁকির মাশুল

২০১০ সালের মেরাপি অগ্নুৎপাতে মারা যায় প্রায় ২,৮০০ গবাদিপশু এবং প্রায় ১২ শতাংশ আর্থিক ক্ষতি ঘটে কৃষি ও পশুপালন খাতে। এমন অবস্থায় পরিবার ও জীবিকার কথা ভেবে মানুষ মাঝে মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আগ্নেয়গিরির ছায়ায় ফিরে যায়।

প্রাণীদেরও আশ্রয় দরকার

এ কারণে ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন দুর্যোগ পরিকল্পনায় গবাদিপশুদের সরানোর বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০২২ সালে বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রধান জানান, কয়েকটি জেলায় পশু উদ্ধার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। কৃষিমন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও দুর্যোগ সংস্থাগুলোর মধ্যে এ নিয়ে যৌথ পরিকল্পনা হচ্ছে।

ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই বেঁচে থাকা

ইন্দোনেশিয়ায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা বেশি এবং জনবসতিও ঘন। ফলে সবাইকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন পরিকল্পনাই এখন মূল কৌশল। এই কাজ সফল করতে হলে স্থানীয় মানুষের বাস্তবতা ও মানসিকতা বুঝে কাজ করতে হবে।

ইন্দোনেশিয়ার মানুষ যেন দুর্যোগের মধ্যেও নিজেদের অনন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে প্রমাণ করছেন—জীবন সবসময় নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে না, বেঁচে থাকাও একপ্রকার সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণের গল্প।

ইন্দোনেশিয়ায় আগ্নেয়গিরির ছায়ায় জীবনযাপন

০৬:৩৯:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

আগ্নেয়গিরির দেশ ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ বাস করে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির একেবারে আসেপাশে। এই ভূখণ্ডে রয়েছে প্রায় ১৩০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি—বিশ্বে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে অনেকগুলোই মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের কাছাকাছি।

আগ্নেয়গিরির ভয়াবহতা ও মানুষের সহাবস্থান

২০১৭ সালে বালির মাউন্ট আগুং-এর অগ্নুৎপাতের সময় প্রায় দেড় লক্ষ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়েছিল। ফটোগ্রাফার পুতু সায়োগা তখন থেকেই আগ্নেয়গিরির আসেপাশে থাকা মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর ভাষায়, ‘‘মানুষগুলো অদ্ভুত রকম শান্ত। যেন আগ্নেয়গিরি তাঁদের জীবনের অঙ্গ।’’

তিনি আগুং থেকে শুরু করে জাভা, সুমাত্রা ও মালুকু দ্বীপের একাধিক আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। এসব মানুষের কাছে আগ্নেয়গিরি শুধু বিপদের উৎস নয়, বরং একধরনের ঐশ্বরিক শক্তি, যাকে ঘিরে চলে ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস ও জীবনধারণ।

বিপদের মাঝেও মানিয়ে নেওয়া

অনেকেই আগ্নেয়গিরির ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পর্কে সচেতন হলেও আতঙ্কে ভোগে না। বরং তারা রীতিমতো উৎসবের মতো করে আগ্নেয়গিরিকে পূজা করে। যেমন, জাভার তেঙ্গেরিজ জনগোষ্ঠী প্রতিবছর কাসাদা উৎসবে চাল, ফল, পশু ইত্যাদি আগ্নেয়গিরির মুখে উৎসর্গ করে। এটি তাদের বিশ্বাসেরই প্রতিফলন।

গবেষকরা বলছেন, এই মানসিকতা গড়ে উঠেছে কারণ এসব অঞ্চলে আগ্নেয়গিরির কোলঘেঁষে বসবাস ও কৃষিকাজ এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ে জমি হয় খুবই উর্বর, যা কৃষির জন্য আশীর্বাদ। ফলে অনেক সময় মানুষ জানে ঝুঁকি আছে, তবুও ফেলে যেতে চায় না জমি, গরু, ঘরবাড়ি।

ভয়াবহ ঘটনাবলি: সিনাবুং ও মেরাপি

সুমাত্রার সিনাবুং আগ্নেয়গিরি ২০১০ সালে ৪০০ বছর পর হঠাৎ করে অগ্নুৎপাত শুরু করে এবং ২০১৩ থেকে এখনো সক্রিয়। গবেষক গ্যাভিন সুলিভান ও সাউত সাগালা অগ্নুৎপাতের ঠিক আগে সেখানে ছিলেন। আগ্নেয়গিরি থেকে আগুনের ধোঁয়া এবং গ্যাস ছড়িয়ে পড়লেও স্থানীয়রা ছিলেন অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত।

এদিকে, ২০১০ সালে মাউন্ট মেরাপির অগ্নুৎপাত ২৭০ জন মানুষের প্রাণ নেয় এবং হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করে। অথচ এর আশেপাশে আজও এক মিলিয়নের বেশি মানুষ বসবাস করে।

কেন মানুষ যায় না অন্যত্র?

২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইন্দোনেশিয়ায় মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নয়, বরং গড় তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের কারণে অন্য প্রদেশে স্থানান্তরিত হয়। আগ্নেয়গিরির মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত মানুষের স্থায়ী স্থানান্তরের প্রধান কারণ হয় না।

এই গবেষণা ইঙ্গিত করে, যেসব পরিবার আগ্নেয়গিরির কারণে স্থানত্যাগ করে, তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ফিরে আসে। মূল কারণ—জমি, গরু ও কৃষিকাজ। ইন্দোনেশিয়ার রেড ক্রসের মুখপাত্র আহমাদ হুসেইন বলেন, ‘‘মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময়ও গরুর কথা ভাবে। গরু না খেয়ে মরলে দায়িত্ব নেবে কে?’’

জীবিকার ঝুঁকির মাশুল

২০১০ সালের মেরাপি অগ্নুৎপাতে মারা যায় প্রায় ২,৮০০ গবাদিপশু এবং প্রায় ১২ শতাংশ আর্থিক ক্ষতি ঘটে কৃষি ও পশুপালন খাতে। এমন অবস্থায় পরিবার ও জীবিকার কথা ভেবে মানুষ মাঝে মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আগ্নেয়গিরির ছায়ায় ফিরে যায়।

প্রাণীদেরও আশ্রয় দরকার

এ কারণে ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন দুর্যোগ পরিকল্পনায় গবাদিপশুদের সরানোর বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০২২ সালে বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রধান জানান, কয়েকটি জেলায় পশু উদ্ধার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। কৃষিমন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও দুর্যোগ সংস্থাগুলোর মধ্যে এ নিয়ে যৌথ পরিকল্পনা হচ্ছে।

ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই বেঁচে থাকা

ইন্দোনেশিয়ায় সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা বেশি এবং জনবসতিও ঘন। ফলে সবাইকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন পরিকল্পনাই এখন মূল কৌশল। এই কাজ সফল করতে হলে স্থানীয় মানুষের বাস্তবতা ও মানসিকতা বুঝে কাজ করতে হবে।

ইন্দোনেশিয়ার মানুষ যেন দুর্যোগের মধ্যেও নিজেদের অনন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে প্রমাণ করছেন—জীবন সবসময় নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে না, বেঁচে থাকাও একপ্রকার সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণের গল্প।