০২:১৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

বন রক্ষা চুক্তির মাঝেও আমাজনে বাড়ছে সয়া চাষ

২০০৬ সালে বিশ্ব-সেরার শস্য ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করা ‘আমাজন সয়া মোরাটোরিয়াম’–এর মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন, ২০০৮ সালের পরে যেসব জমিতে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে সেখানকার সয়া কিনবেন না। দুই দশক পেরিয়ে সেই চুক্তির বয়স যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এর ফাঁকফোকর খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা; ফলশ্রুতিতে আমাজন বনের বুক চিরে আরও গভীরে ঢুকে পড়ছে সয়া খেত।

‘সেকেন্ডারি’ বন: চুক্তির বাইরে রাখা ধূসর ক্ষেত্র

মোরাটোরিয়াম কেবল সেই পুরোনো, আগে কখনও ছোঁয়া না-লাগা প্রাথমিক বনকে সুরক্ষা দেয়। অথচ আগে কাটা পড়ে যে জমিতে বন আবার জন্ম নিয়েছে—যাকে ‘সেকেন্ডারি ফরেস্ট’ বলা হয়—সেটি এই সুরক্ষার বাইরে। কৃষকেরা তাই আইনভঙ্গ না করেই সেই জমি পরিষ্কার করে সয়া চাষ করতে পারছেন এবং পণ্যটিকেও ‘ডিফরেস্টেশন-মুক্ত’ বলে বাজারজাত করছেন।

উপাত্তে ভিন্নমত

চুক্তি তত্ত্বাবধানকারী সংগঠন আবিওভের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮-২৩ সালে কুমারী বনে সয়া খেত ৮৫ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে—সব সয়া খেতের ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ভৌগোলিক বিজ্ঞানী জিয়াওপেং সং স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ২০০৮-এর পর কাটা জমিতেই আজ ১০ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর—অর্থাৎ আমাজনের ১৬ শতাংশ সয়া খেত গড়ে উঠেছে। তিনি সেকেন্ডারি বনকে চুক্তির আওতায় আনার পক্ষে; আবিওভ অবশ্য বলছে, তাদের পদ্ধতি ‘পুরোনো বন রক্ষায়’ কেন্দ্রিত, বিস্তৃত মানদণ্ডে নয়।

জলবায়ু ঝুঁকি ও বিজ্ঞানীদের সতর্কতা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যখন খরাপ্রবণতা ও তাপমাত্রা বেড়ে বনকে সাভানায় রূপান্তরের ‘টিপিং-পয়েন্টে’ ঠেলে দিচ্ছে, তখন শুধু বন কাটা থামানোই নয়, পুনরায় বন বাড়ানোও জরুরি। গবেষক ভিওলা হাইনরিশ মনে করেন, বায়ুমণ্ডল থেকে দ্রুত কার্বন টেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকায় সেকেন্ডারি বন প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে ‘অপরিহার্য’। যদিও কার্বন সংরক্ষণ ক্ষমতায় এগুলো প্রাথমিক বনের তুলনায় কম।

স্থানীয় চিত্র: সান্তারেমের বুক চিরে সয়া

সান্তারেম শহরের উপকণ্ঠে কৃষকেরা ৩০ বছর বয়সী সেকেন্ডারি বন কেটে চাষের শেষ ধাপে—বিভিন্ন স্তরে গাছ ফেলে সারি সারি করে জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছিল। চার্চ-সমর্থিত গ্রুপ ‘পাস্তোরাল ল্যান্ড কমিশন’-এর গিলসন রেগো বললেন, ‘একবার যেটা নেওয়া যায়, আবারও নেওয়া যায়।’ তাঁর দেখা অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে সয়াখেত চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। কারণ কাছেই রয়েছে বিশাল শিপিং টার্মিনাল।

অর্থনীতি বনাম পরিবেশ

বিশ্বের শীর্ষ সয়া রপ্তানিকারক এখন ব্রাজিল; উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই যায় চীনে। কৃষকেরা যুক্তি দেন, দরিদ্র দেশে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ‘ইউরোপ বন কেটে উন্নত হয়েছে, আর আমাদের আইনকানুনে আটকে রাখা হচ্ছে’—বলছেন স্থানীয় কৃষক নেতা আদেলিনো নইমান।

মোরাটোরিয়ামের ওপর আইনি চাপ

ডানপন্থি রাজনীতিবিদ-সমর্থিত কৃষক গোষ্ঠীগুলো মোরাটোরিয়াম দুর্বল করতে মামলা ও আইন প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে। এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে বলা হয়, যারা চুক্তিতে সই করেছে তাদের দেওয়া কর-ছাড় বাতিল করা যেতে পারে। আবিওভের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে নাসার ইঙ্গিত দিয়েছেন, কৃষকদের খুশি করতে কিছু নিয়ম শিথিল হতে পারে। এই অবস্থায় পরিবেশবাদীরা বলছেন, ত্রুটি-সহেও চুক্তি যতটুকু রক্ষা দেয়, তাতেও বড় চাপ কমে; তবে ফাঁকফোকর বন্ধ করা জরুরি।

স্থানীয় ক্ষতি: শিশুদের বিষক্রিয়া, জমির দখল

সান্তারেম-ঘেঁষা বেলটেরা শহরে স্কুল ও কবরস্থান ছাড়া সব জায়গায় সয়াখেত ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলশিক্ষক রাইমুন্দো সাউসা ফ্রেইতাস দেখিয়েছেন, কীভাবে কীটনাশকের প্রভাবে ৮০ শিশু পেটব্যথা-বমি-অসুস্থতায় ভুগেছিল। এক কৃষককে জরিমানা করা হলেও জমি দখলের গতি থামেনি। মাঝে মাঝে আইনসঙ্গতভাবে রক্ষা করা বিশাল কয়েকটি গাছ সয়া-প্রান্তরে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে প্রমাণ করছে—এখানে একদিন ঘন অরণ্য ছিল।

স্যাটেলাইটে ধরা ছবি, মাঠের অভিজ্ঞতা আর আদালতের রায়—সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, মোরাটোরিয়ামের আড়ালে সয়া চাষ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং সেকেন্ডারি বন সুরক্ষার অভাবে বড় ফাঁক রয়ে গেছে। নীতি-নিয়ন্ত্রকেরা যদি এই ফাঁক বন্ধ করতে না পারেন, তবে আমাজনকে রক্ষা করার অঙ্গীকার অল্পসময়ে ছ্যাঁকা খেয়ে যাবে, আর বিশ্ব-জলবায়ু সংকটও দ্রুততর হবে।

বন রক্ষা চুক্তির মাঝেও আমাজনে বাড়ছে সয়া চাষ

০৫:০০:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

২০০৬ সালে বিশ্ব-সেরার শস্য ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করা ‘আমাজন সয়া মোরাটোরিয়াম’–এর মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন, ২০০৮ সালের পরে যেসব জমিতে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে সেখানকার সয়া কিনবেন না। দুই দশক পেরিয়ে সেই চুক্তির বয়স যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এর ফাঁকফোকর খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা; ফলশ্রুতিতে আমাজন বনের বুক চিরে আরও গভীরে ঢুকে পড়ছে সয়া খেত।

‘সেকেন্ডারি’ বন: চুক্তির বাইরে রাখা ধূসর ক্ষেত্র

মোরাটোরিয়াম কেবল সেই পুরোনো, আগে কখনও ছোঁয়া না-লাগা প্রাথমিক বনকে সুরক্ষা দেয়। অথচ আগে কাটা পড়ে যে জমিতে বন আবার জন্ম নিয়েছে—যাকে ‘সেকেন্ডারি ফরেস্ট’ বলা হয়—সেটি এই সুরক্ষার বাইরে। কৃষকেরা তাই আইনভঙ্গ না করেই সেই জমি পরিষ্কার করে সয়া চাষ করতে পারছেন এবং পণ্যটিকেও ‘ডিফরেস্টেশন-মুক্ত’ বলে বাজারজাত করছেন।

উপাত্তে ভিন্নমত

চুক্তি তত্ত্বাবধানকারী সংগঠন আবিওভের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮-২৩ সালে কুমারী বনে সয়া খেত ৮৫ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে—সব সয়া খেতের ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ভৌগোলিক বিজ্ঞানী জিয়াওপেং সং স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, ২০০৮-এর পর কাটা জমিতেই আজ ১০ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর—অর্থাৎ আমাজনের ১৬ শতাংশ সয়া খেত গড়ে উঠেছে। তিনি সেকেন্ডারি বনকে চুক্তির আওতায় আনার পক্ষে; আবিওভ অবশ্য বলছে, তাদের পদ্ধতি ‘পুরোনো বন রক্ষায়’ কেন্দ্রিত, বিস্তৃত মানদণ্ডে নয়।

জলবায়ু ঝুঁকি ও বিজ্ঞানীদের সতর্কতা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যখন খরাপ্রবণতা ও তাপমাত্রা বেড়ে বনকে সাভানায় রূপান্তরের ‘টিপিং-পয়েন্টে’ ঠেলে দিচ্ছে, তখন শুধু বন কাটা থামানোই নয়, পুনরায় বন বাড়ানোও জরুরি। গবেষক ভিওলা হাইনরিশ মনে করেন, বায়ুমণ্ডল থেকে দ্রুত কার্বন টেনে নেওয়ার ক্ষমতা থাকায় সেকেন্ডারি বন প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে ‘অপরিহার্য’। যদিও কার্বন সংরক্ষণ ক্ষমতায় এগুলো প্রাথমিক বনের তুলনায় কম।

স্থানীয় চিত্র: সান্তারেমের বুক চিরে সয়া

সান্তারেম শহরের উপকণ্ঠে কৃষকেরা ৩০ বছর বয়সী সেকেন্ডারি বন কেটে চাষের শেষ ধাপে—বিভিন্ন স্তরে গাছ ফেলে সারি সারি করে জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছিল। চার্চ-সমর্থিত গ্রুপ ‘পাস্তোরাল ল্যান্ড কমিশন’-এর গিলসন রেগো বললেন, ‘একবার যেটা নেওয়া যায়, আবারও নেওয়া যায়।’ তাঁর দেখা অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে সয়াখেত চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। কারণ কাছেই রয়েছে বিশাল শিপিং টার্মিনাল।

অর্থনীতি বনাম পরিবেশ

বিশ্বের শীর্ষ সয়া রপ্তানিকারক এখন ব্রাজিল; উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই যায় চীনে। কৃষকেরা যুক্তি দেন, দরিদ্র দেশে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ‘ইউরোপ বন কেটে উন্নত হয়েছে, আর আমাদের আইনকানুনে আটকে রাখা হচ্ছে’—বলছেন স্থানীয় কৃষক নেতা আদেলিনো নইমান।

মোরাটোরিয়ামের ওপর আইনি চাপ

ডানপন্থি রাজনীতিবিদ-সমর্থিত কৃষক গোষ্ঠীগুলো মোরাটোরিয়াম দুর্বল করতে মামলা ও আইন প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে। এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে বলা হয়, যারা চুক্তিতে সই করেছে তাদের দেওয়া কর-ছাড় বাতিল করা যেতে পারে। আবিওভের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে নাসার ইঙ্গিত দিয়েছেন, কৃষকদের খুশি করতে কিছু নিয়ম শিথিল হতে পারে। এই অবস্থায় পরিবেশবাদীরা বলছেন, ত্রুটি-সহেও চুক্তি যতটুকু রক্ষা দেয়, তাতেও বড় চাপ কমে; তবে ফাঁকফোকর বন্ধ করা জরুরি।

স্থানীয় ক্ষতি: শিশুদের বিষক্রিয়া, জমির দখল

সান্তারেম-ঘেঁষা বেলটেরা শহরে স্কুল ও কবরস্থান ছাড়া সব জায়গায় সয়াখেত ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলশিক্ষক রাইমুন্দো সাউসা ফ্রেইতাস দেখিয়েছেন, কীভাবে কীটনাশকের প্রভাবে ৮০ শিশু পেটব্যথা-বমি-অসুস্থতায় ভুগেছিল। এক কৃষককে জরিমানা করা হলেও জমি দখলের গতি থামেনি। মাঝে মাঝে আইনসঙ্গতভাবে রক্ষা করা বিশাল কয়েকটি গাছ সয়া-প্রান্তরে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে প্রমাণ করছে—এখানে একদিন ঘন অরণ্য ছিল।

স্যাটেলাইটে ধরা ছবি, মাঠের অভিজ্ঞতা আর আদালতের রায়—সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে, মোরাটোরিয়ামের আড়ালে সয়া চাষ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং সেকেন্ডারি বন সুরক্ষার অভাবে বড় ফাঁক রয়ে গেছে। নীতি-নিয়ন্ত্রকেরা যদি এই ফাঁক বন্ধ করতে না পারেন, তবে আমাজনকে রক্ষা করার অঙ্গীকার অল্পসময়ে ছ্যাঁকা খেয়ে যাবে, আর বিশ্ব-জলবায়ু সংকটও দ্রুততর হবে।