০৮:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া উনসানে সমুদ্র সৈকতের রিসোর্ট উদ্বোধন: পর্যটনে বাজি ধরছে উত্তর কোরিয়া ওএমএস ও টিসিবি ডিলার নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান এসএসসি টেস্টের দুই দিনে শ্রীলঙ্কার রাজত্ব রাসেল ভাইপারের হুমকি: শহরেও ঢুকছে বিপজ্জনক সাপ! মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ ২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের

বিএনপির সমালোচনায় ইসলামী আন্দোলন : সংকেত কী?

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পরে এখন পর্যন্ত শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে ১২৭ জনেরও বেশি। যাদের কাছে নিজের দলের মানুষ নিরাপদ নয়, তাদের কাছে বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। এত দিন আমরা জানতাম, জাহান্নামের আগুন জাহান্নামকে খেয়ে ফেলে। এখন আমরা দেখছি, এক বিএনপি আরেক বিএনপিকে খেয়ে ফেলছে।’

২০ জুন শুক্রবার বিকেলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে চার দফা দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গণসমাবেশে মুহাম্মদ ফয়জুল করীম আরও বলেন, ‘যাদের কাছে নিজেদের দলের মানুষ নিরাপদ নয়, তাদের কাছে বাংলাদেশের নাগরিক নিরাপদ হতে পারে না। যে দলের এক সংগঠককে আরেক সংগঠককে চাঁদা দিতে হয়, সেই দলের কাছে বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী নিরাপদ থাকতে পারে না। যেই দলের মানুষ মানুষকে খুন করে, সেই দলের কাছে বাংলাদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা থাকতে পারে না। যেই দল নিজেদের সংরক্ষণ করতে পারে না, নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা-শিষ্টাচার বজায় রাখতে পারে না, তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের শৃঙ্খলা ঠিক থাকতে পারে না।’

বিএনপির নেতা ইশরাকের সমালোচনা করে আমির ফয়জুল করীম বলেন, ‘ইশরাক সাহেবের উকিলরা বিচারককে বলেছেন, ইশরাকের পক্ষে রায় দেন তাহলে ওখানে থাকবেন। রায় না দিলে ওখানে ঢুকতে পারবেন না। যাঁরা জোর করে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে আসেন, তাঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচারালয় কোনো দিন নিরাপদ থাকতে পারে না। কত রক্ত দেবেন, আবু সাঈদ কতবার জন্ম নেবে। আমরা অবৈধ সরকার, অবৈধ ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আনার জন্য একফোঁটা রক্ত ঝরাতে চাই না। আমরা দুর্নীতিবাজ চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’

আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘যারা নিজেরাই ঘোষণা দেয়—নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করো, না হলে আমরাই ঘোষণা দেব। যারা নিজেরা আইন তুলে নেয়, তাদের মাধ্যমে এ দেশের আইন নিরাপদ থাকতে পারে না। যারা মেয়র হওয়ার আগেই সিটি করপোরেশন ভবন দখল করে, তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা থাকতে পারে না। এদের বাংলাদেশের মানুষ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করবে না।’

এ সময় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৬টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে পাঁচ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন তিনি। রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটি আংশিক) আসনের প্রার্থী হিসেবে এটিএম গোলাম মোস্তফা বাবু, রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে মাওলানা মো. আশরাফ আলী, রংপুর-৩ (সদর) আসন থেকে আমিরুজ্জামান পিয়াল, রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন এবং রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে মোহাম্মদ গোলজার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়।

রংপুরের মাটি দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য একটি প্রাসঙ্গিক জনভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু এবার রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (ইআবা) আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের বক্তব্য রাজনৈতিক সমীকরণে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। তিনি কেবল সরকারবিরোধী অবস্থান নেননি, বরং বিরোধীদল বিএনপিকেও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে যে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি তার নিজস্ব অবস্থান ও নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে এবং এই সংকটকে পুঁজি করে বিকল্প বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছে ইসলামী আন্দোলন।

নিজেরাই নিজের শত্রু?
মুফতি ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘বিএনপি বিএনপিকে খেয়ে ফেলছে’, আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক রসিকতা মনে হলেও গভীরভাবে দেখলে তা একটি রাজনৈতিক সত্যকেই তুলে ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব, কিংবা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের হতাশা—এসব তথ্য অনেক সময়ই সামনে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ফয়জুল করীম এখানে একটি মেটাফোর ব্যবহার করে সেই অসন্তোষকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যারা নিজেদের দলকেই রক্ষা করতে পারছে না, তারা রাষ্ট্র রক্ষার দাবিদার হতে পারে না।

বিএনপিকে আক্রমণ করে কে লাভবান?
এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপিকে নিশানা করে ইসলামী আন্দোলনের এই বক্তব্য কেবল বক্তৃতার পরিবেশ তৈরি করার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের জায়গা তৈরির কৌশল হিসেবেও বিবেচ্য। ইসলামী আন্দোলন বরাবরই একটি ‘আলাদা রাজনৈতিক ধারার’ দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে এসেছে—যারা Neither BNP Nor AL, বরং ‘স্বতন্ত্র, ইসলামপন্থী বিকল্প’।

বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তারা মাঠের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে চায়: ‘সরকার বিরোধী মানেই বিএনপি নয়, আমরাও একটি বিকল্প শক্তি।’

রক্তরায় এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা
ফয়জুল করীমের বক্তব্যে কয়েকটি ধারালো পয়েন্ট এসেছে—যেমন তিনি বলেছেন, ‘আমরা অবৈধ সরকার ও অবৈধ ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আনতে একফোঁটা রক্তও ঝরাতে চাই না।’ এতে বোঝা যায়, ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ বর্তমান পরিস্থিতিকে সহিংস আন্দোলনের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে একটি ‘নৈতিক বিরোধিতা’র অবস্থা তৈরি করতে চাইছে। একই সঙ্গে বিএনপির আইনি লড়াই ও মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখিয়ে তিনি বিএনপিকে একরকম ‘সন্ত্রাস-ঘেঁষা, বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিতকারী’ শক্তি হিসেবেও চিত্রিত করছেন।

ভোট রাজনীতির প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কৌশল
এই বক্তব্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে ৫টিতে প্রার্থী ঘোষণা। এটি আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি প্রকাশ্য ঘোষণা। সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে যে বিভক্তি রয়েছে, ইসলামী আন্দোলন তা পরিষ্কার করে দিয়েছে—তারা নির্বাচন বর্জনের পথ নয়, বরং অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ বেছে নিয়েছে।

এটা সাম্প্রতিক সময়ে দলটির কৌশলগত অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়: তারা আর কেবল ধর্মভিত্তিক নীতিগত বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বরং সংসদীয় রাজনীতির একটি বাস্তব অংশ হতে চায়। এ কারণে বিএনপিকে আক্রমণ করে তারা নিজেদের ‘সংযত, শৃঙ্খলিত ও বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে?
ইসলামী আন্দোলনের এই বক্তব্য সরাসরি জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে—এমনটা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এটি স্পষ্ট যে, তারা বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং সেই শূন্যস্থান পূরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে পেছনে পড়ে যাচ্ছে, তা তারা যতটা না সরকারকে দায়ী করে বলছে, তার চেয়ে বেশি বলছে বিএনপির ‘নিজেদের ব্যর্থতা’ই বড় কারণ।

এটা বিএনপির জন্য চিন্তার বিষয়, কারণ বিরোধী জোটের মধ্যেই যদি এমন তীব্র আক্রমণ চলে, তবে সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত অবস্থান গঠনের সম্ভাবনা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

মুফতি ফয়জুল করীমের রংপুরের বক্তব্য কেবল বক্তব্য নয়—এটি একটি কৌশলগত ঘোষণাও। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামী আন্দোলন এখন শুধু আদর্শগত দল নয়, তারা বাস্তব রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। বিএনপির দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও জনসমর্থনের অবক্ষয়ের অভিযোগকে সামনে রেখে তারা নিজেদের তুলনামূলক ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।

বাংলাদেশের রাজনীতি তাই আজ দ্বিমুখী চাপে—একদিকে শাসকগোষ্ঠী, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে অনৈক্যবিষয়ক প্রশ্নে জর্জরিত বিরোধী শিবির। এই পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল ঠিক কতটা কার্যকর হয়, তা নির্ভর করবে একদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার পুনরুদ্ধার আর অন্যদিকে নির্বাচনী বাস্তবতায় ভোটারের প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে একটি কথা স্পষ্ট—এখন আর সরকারবিরোধী বললেই ভোট মিলবে না, প্রমাণ করতে হবে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতা। ইসলামী আন্দোলন কী সেটাই প্রমাণ করতে চায়?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিকরাজনৈতিক বিশ্লেষক।

৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া

বিএনপির সমালোচনায় ইসলামী আন্দোলন : সংকেত কী?

০৮:০০:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পরে এখন পর্যন্ত শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে ১২৭ জনেরও বেশি। যাদের কাছে নিজের দলের মানুষ নিরাপদ নয়, তাদের কাছে বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। এত দিন আমরা জানতাম, জাহান্নামের আগুন জাহান্নামকে খেয়ে ফেলে। এখন আমরা দেখছি, এক বিএনপি আরেক বিএনপিকে খেয়ে ফেলছে।’

২০ জুন শুক্রবার বিকেলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে চার দফা দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গণসমাবেশে মুহাম্মদ ফয়জুল করীম আরও বলেন, ‘যাদের কাছে নিজেদের দলের মানুষ নিরাপদ নয়, তাদের কাছে বাংলাদেশের নাগরিক নিরাপদ হতে পারে না। যে দলের এক সংগঠককে আরেক সংগঠককে চাঁদা দিতে হয়, সেই দলের কাছে বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী নিরাপদ থাকতে পারে না। যেই দলের মানুষ মানুষকে খুন করে, সেই দলের কাছে বাংলাদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা থাকতে পারে না। যেই দল নিজেদের সংরক্ষণ করতে পারে না, নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা-শিষ্টাচার বজায় রাখতে পারে না, তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের শৃঙ্খলা ঠিক থাকতে পারে না।’

বিএনপির নেতা ইশরাকের সমালোচনা করে আমির ফয়জুল করীম বলেন, ‘ইশরাক সাহেবের উকিলরা বিচারককে বলেছেন, ইশরাকের পক্ষে রায় দেন তাহলে ওখানে থাকবেন। রায় না দিলে ওখানে ঢুকতে পারবেন না। যাঁরা জোর করে নিজেদের পক্ষে রায় নিয়ে আসেন, তাঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচারালয় কোনো দিন নিরাপদ থাকতে পারে না। কত রক্ত দেবেন, আবু সাঈদ কতবার জন্ম নেবে। আমরা অবৈধ সরকার, অবৈধ ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আনার জন্য একফোঁটা রক্ত ঝরাতে চাই না। আমরা দুর্নীতিবাজ চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় দেখতে চাই না।’

আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘যারা নিজেরাই ঘোষণা দেয়—নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করো, না হলে আমরাই ঘোষণা দেব। যারা নিজেরা আইন তুলে নেয়, তাদের মাধ্যমে এ দেশের আইন নিরাপদ থাকতে পারে না। যারা মেয়র হওয়ার আগেই সিটি করপোরেশন ভবন দখল করে, তাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা থাকতে পারে না। এদের বাংলাদেশের মানুষ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করবে না।’

এ সময় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৬টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে পাঁচ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন তিনি। রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটি আংশিক) আসনের প্রার্থী হিসেবে এটিএম গোলাম মোস্তফা বাবু, রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে মাওলানা মো. আশরাফ আলী, রংপুর-৩ (সদর) আসন থেকে আমিরুজ্জামান পিয়াল, রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) আসন থেকে মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন এবং রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে মোহাম্মদ গোলজার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়।

রংপুরের মাটি দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য একটি প্রাসঙ্গিক জনভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু এবার রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (ইআবা) আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের বক্তব্য রাজনৈতিক সমীকরণে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। তিনি কেবল সরকারবিরোধী অবস্থান নেননি, বরং বিরোধীদল বিএনপিকেও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠেছে যে, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি তার নিজস্ব অবস্থান ও নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে এবং এই সংকটকে পুঁজি করে বিকল্প বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইছে ইসলামী আন্দোলন।

নিজেরাই নিজের শত্রু?
মুফতি ফয়জুল করীম বলেছেন, ‘বিএনপি বিএনপিকে খেয়ে ফেলছে’, আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক রসিকতা মনে হলেও গভীরভাবে দেখলে তা একটি রাজনৈতিক সত্যকেই তুলে ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব, কিংবা মাঠপর্যায়ের কর্মীদের হতাশা—এসব তথ্য অনেক সময়ই সামনে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ফয়জুল করীম এখানে একটি মেটাফোর ব্যবহার করে সেই অসন্তোষকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যারা নিজেদের দলকেই রক্ষা করতে পারছে না, তারা রাষ্ট্র রক্ষার দাবিদার হতে পারে না।

বিএনপিকে আক্রমণ করে কে লাভবান?
এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপিকে নিশানা করে ইসলামী আন্দোলনের এই বক্তব্য কেবল বক্তৃতার পরিবেশ তৈরি করার জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের জায়গা তৈরির কৌশল হিসেবেও বিবেচ্য। ইসলামী আন্দোলন বরাবরই একটি ‘আলাদা রাজনৈতিক ধারার’ দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে এসেছে—যারা Neither BNP Nor AL, বরং ‘স্বতন্ত্র, ইসলামপন্থী বিকল্প’।

বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তারা মাঠের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে চায়: ‘সরকার বিরোধী মানেই বিএনপি নয়, আমরাও একটি বিকল্প শক্তি।’

রক্তরায় এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা
ফয়জুল করীমের বক্তব্যে কয়েকটি ধারালো পয়েন্ট এসেছে—যেমন তিনি বলেছেন, ‘আমরা অবৈধ সরকার ও অবৈধ ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আনতে একফোঁটা রক্তও ঝরাতে চাই না।’ এতে বোঝা যায়, ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ বর্তমান পরিস্থিতিকে সহিংস আন্দোলনের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে একটি ‘নৈতিক বিরোধিতা’র অবস্থা তৈরি করতে চাইছে। একই সঙ্গে বিএনপির আইনি লড়াই ও মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখিয়ে তিনি বিএনপিকে একরকম ‘সন্ত্রাস-ঘেঁষা, বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিতকারী’ শক্তি হিসেবেও চিত্রিত করছেন।

ভোট রাজনীতির প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কৌশল
এই বক্তব্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে ৫টিতে প্রার্থী ঘোষণা। এটি আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি প্রকাশ্য ঘোষণা। সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে যে বিভক্তি রয়েছে, ইসলামী আন্দোলন তা পরিষ্কার করে দিয়েছে—তারা নির্বাচন বর্জনের পথ নয়, বরং অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ বেছে নিয়েছে।

এটা সাম্প্রতিক সময়ে দলটির কৌশলগত অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়: তারা আর কেবল ধর্মভিত্তিক নীতিগত বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, বরং সংসদীয় রাজনীতির একটি বাস্তব অংশ হতে চায়। এ কারণে বিএনপিকে আক্রমণ করে তারা নিজেদের ‘সংযত, শৃঙ্খলিত ও বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে?
ইসলামী আন্দোলনের এই বক্তব্য সরাসরি জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে—এমনটা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এটি স্পষ্ট যে, তারা বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং সেই শূন্যস্থান পূরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে পেছনে পড়ে যাচ্ছে, তা তারা যতটা না সরকারকে দায়ী করে বলছে, তার চেয়ে বেশি বলছে বিএনপির ‘নিজেদের ব্যর্থতা’ই বড় কারণ।

এটা বিএনপির জন্য চিন্তার বিষয়, কারণ বিরোধী জোটের মধ্যেই যদি এমন তীব্র আক্রমণ চলে, তবে সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত অবস্থান গঠনের সম্ভাবনা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

মুফতি ফয়জুল করীমের রংপুরের বক্তব্য কেবল বক্তব্য নয়—এটি একটি কৌশলগত ঘোষণাও। এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামী আন্দোলন এখন শুধু আদর্শগত দল নয়, তারা বাস্তব রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। বিএনপির দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও জনসমর্থনের অবক্ষয়ের অভিযোগকে সামনে রেখে তারা নিজেদের তুলনামূলক ‘নিরাপদ বিকল্প’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়।

বাংলাদেশের রাজনীতি তাই আজ দ্বিমুখী চাপে—একদিকে শাসকগোষ্ঠী, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে অনৈক্যবিষয়ক প্রশ্নে জর্জরিত বিরোধী শিবির। এই পরিস্থিতিতে ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল ঠিক কতটা কার্যকর হয়, তা নির্ভর করবে একদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার পুনরুদ্ধার আর অন্যদিকে নির্বাচনী বাস্তবতায় ভোটারের প্রতিক্রিয়ার ওপর। তবে একটি কথা স্পষ্ট—এখন আর সরকারবিরোধী বললেই ভোট মিলবে না, প্রমাণ করতে হবে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতা। ইসলামী আন্দোলন কী সেটাই প্রমাণ করতে চায়?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিকরাজনৈতিক বিশ্লেষক।