০২:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ভারত জ্বালানি ও যোগাযোগ সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ফলে

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ভারতের স্বার্থে বিপদ ডেকে আনছে

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক হামলার ফলে ভারতের আঞ্চলিক যোগাযোগ ও জ্বালানি নিরাপত্তা প্রকল্পগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের চাবাহার বন্দরকে ঘিরে ভারতের যে বড় প্রকল্প রয়েছে, তা এখন হুমকির মুখে।

দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি. পন্ত বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বাড়লে ভারতীয় স্বার্থ বিপন্ন হয়। ভারতের সঙ্গে উভয় দেশেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা সরাসরি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।”

এসসিওর নিন্দা থেকে সরে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান

রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) ইসরায়েলের সামরিক হামলার নিন্দা জানালেও ভারত সে বিবৃতিতে সই করেনি। বরং ১৩ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল ও ইরান উভয় পক্ষকে উত্তেজনা না বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং বিদ্যমান কূটনৈতিক ও সংলাপচ্যানেল ব্যবহার করে পরিস্থিতি শান্ত করতে বলা হয়েছে।

ইসরায়েল-ইরানের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন চ্যালেঞ্জ

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার পাণ্ডে বলেন, “ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সামরিক অংশীদারিত্ব গড়েছে। ইসরায়েল এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম ও সম্ভবত গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী। অন্যদিকে ইরান ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদার। ফলে ভারসাম্য রক্ষা ভারতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।”

চাবাহার ও অন্যান্য প্রকল্প এখন অনিশ্চয়তার মুখে

চাবাহার বন্দর কিংবা আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর (INSTC) প্রকল্প সবই এখন অনিশ্চয়তায়। গাজা যুদ্ধের কারণে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) প্রকল্প ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে আছে।

ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য আফগানিস্তানে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে বাইপাস করে মধ্য এশিয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি G20 সম্মেলনে IMEC প্রকল্প ঘোষণা করেন, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের পাল্টা উদ্যোগ হিসেবে দেখা হয়।

২০২৪ সালের মে মাসে ভারত চাবাহার বন্দর পরিচালনার জন্য ইরানের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তি করে। এর আওতায় ভারত ১২ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে এবং বন্দর এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২৫ কোটি ডলারের ঋণ সুবিধা দেবে। এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের গওয়াদর বন্দরের প্রভাব কমাতে চায়, যা চীনের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।

অঞ্চলীয় অস্থিরতা ভারতের প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের হর্ষ পন্ত বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যখনই বড় ধরনের সংঘাত হয়, তখন ভারতের ঐতিহ্যগত কৌশল চাপের মুখে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।”

এ বিষয়ে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GRTI)-এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এই অঞ্চলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এখনকার উত্তেজনা সেই সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে।”

ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়িয়ে জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় চাপ

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ইরানে ১.২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং আমদানি করেছে ৪৪১.৯ মিলিয়ন ডলার। ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আরও বড় – রপ্তানি ২.১৫ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ১.৬১ বিলিয়ন ডলার।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের অর্ধেকই আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে, যা ইরান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।

শ্রীবাস্তব বলেন, “এই প্রণালী বিশ্বের মোট তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পরিবহন করে। এর প্রস্থ সবচেয়ে সরু অংশে মাত্র ২১ মাইল। ভারত যেহেতু ৮০ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাই এ প্রণালী ভারতের জন্য অপরিহার্য। এর যেকোনো সামরিক বা কৌশলগত বিঘ্ন তেলের দাম বাড়াবে, পরিবহন ও বীমা খরচ বাড়াবে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি, রুপি দুর্বলতা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হবে।”

তিনি আরও বলেন, এই ঝুঁকি আরও তাৎক্ষণিক হয়ে ওঠে যখন ১৫ জুন ইরান ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ওই বন্দর ইসরায়েলের মোট আমদানির ৩০ শতাংশ পরিচালনা করে এবং এর ৭০ শতাংশ মালিকানা ভারতের আদানি পোর্টসের।

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক উত্তেজনা কেবল দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ নয়, বরং এর ধাক্কা ভারতসহ গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার উপর পড়তে শুরু করেছে। ভারত এখন কঠিন কূটনৈতিক সমীকরণের মুখে, যেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় তাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

ভারত জ্বালানি ও যোগাযোগ সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ফলে

১১:৫০:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ভারতের স্বার্থে বিপদ ডেকে আনছে

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সামরিক হামলার ফলে ভারতের আঞ্চলিক যোগাযোগ ও জ্বালানি নিরাপত্তা প্রকল্পগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের চাবাহার বন্দরকে ঘিরে ভারতের যে বড় প্রকল্প রয়েছে, তা এখন হুমকির মুখে।

দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি. পন্ত বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বাড়লে ভারতীয় স্বার্থ বিপন্ন হয়। ভারতের সঙ্গে উভয় দেশেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা সরাসরি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।”

এসসিওর নিন্দা থেকে সরে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান

রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) ইসরায়েলের সামরিক হামলার নিন্দা জানালেও ভারত সে বিবৃতিতে সই করেনি। বরং ১৩ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল ও ইরান উভয় পক্ষকে উত্তেজনা না বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং বিদ্যমান কূটনৈতিক ও সংলাপচ্যানেল ব্যবহার করে পরিস্থিতি শান্ত করতে বলা হয়েছে।

ইসরায়েল-ইরানের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন চ্যালেঞ্জ

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার পাণ্ডে বলেন, “ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা ও সামরিক অংশীদারিত্ব গড়েছে। ইসরায়েল এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম ও সম্ভবত গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী। অন্যদিকে ইরান ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদার। ফলে ভারসাম্য রক্ষা ভারতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।”

চাবাহার ও অন্যান্য প্রকল্প এখন অনিশ্চয়তার মুখে

চাবাহার বন্দর কিংবা আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর (INSTC) প্রকল্প সবই এখন অনিশ্চয়তায়। গাজা যুদ্ধের কারণে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) প্রকল্প ইতোমধ্যেই স্থবির হয়ে আছে।

ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য আফগানিস্তানে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানকে বাইপাস করে মধ্য এশিয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি G20 সম্মেলনে IMEC প্রকল্প ঘোষণা করেন, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের পাল্টা উদ্যোগ হিসেবে দেখা হয়।

২০২৪ সালের মে মাসে ভারত চাবাহার বন্দর পরিচালনার জন্য ইরানের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তি করে। এর আওতায় ভারত ১২ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে এবং বন্দর এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২৫ কোটি ডলারের ঋণ সুবিধা দেবে। এই বন্দরের মাধ্যমে ভারত পাকিস্তানের গওয়াদর বন্দরের প্রভাব কমাতে চায়, যা চীনের অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।

অঞ্চলীয় অস্থিরতা ভারতের প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের হর্ষ পন্ত বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যখনই বড় ধরনের সংঘাত হয়, তখন ভারতের ঐতিহ্যগত কৌশল চাপের মুখে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।”

এ বিষয়ে গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GRTI)-এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক এই অঞ্চলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এখনকার উত্তেজনা সেই সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলেছে।”

ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়িয়ে জ্বালানি নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় চাপ

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ইরানে ১.২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং আমদানি করেছে ৪৪১.৯ মিলিয়ন ডলার। ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আরও বড় – রপ্তানি ২.১৫ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ১.৬১ বিলিয়ন ডলার।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের অর্ধেকই আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে, যা ইরান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।

শ্রীবাস্তব বলেন, “এই প্রণালী বিশ্বের মোট তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ পরিবহন করে। এর প্রস্থ সবচেয়ে সরু অংশে মাত্র ২১ মাইল। ভারত যেহেতু ৮০ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাই এ প্রণালী ভারতের জন্য অপরিহার্য। এর যেকোনো সামরিক বা কৌশলগত বিঘ্ন তেলের দাম বাড়াবে, পরিবহন ও বীমা খরচ বাড়াবে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি, রুপি দুর্বলতা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হবে।”

তিনি আরও বলেন, এই ঝুঁকি আরও তাৎক্ষণিক হয়ে ওঠে যখন ১৫ জুন ইরান ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ওই বন্দর ইসরায়েলের মোট আমদানির ৩০ শতাংশ পরিচালনা করে এবং এর ৭০ শতাংশ মালিকানা ভারতের আদানি পোর্টসের।

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক উত্তেজনা কেবল দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ নয়, বরং এর ধাক্কা ভারতসহ গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার উপর পড়তে শুরু করেছে। ভারত এখন কঠিন কূটনৈতিক সমীকরণের মুখে, যেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় তাকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।