“এখন শান্তির সময়,”—এই ঘোষণা দিয়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার অনুমোদন দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এরপর কী ঘটবে তা নিজেও অনুমান করতে পারেন না ট্রাম্প। তিনি বরং কূটনৈতিক সুবিধা বিসর্জন দিয়ে, মার্কিন নাগরিকদের ঝুঁকিতে ফেলে এবং তার দ্বিতীয় মেয়াদের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার—যেমন ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এশিয়ার ওপর নতুন করে মনোযোগ—হুমকির মুখে ফেলেছেন।
এই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখন আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, তবে এর ফলাফল সীমিত রাখতে ট্রাম্পের উচিত দ্রুত উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং এমন এক মধ্যপ্রাচ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার চাপ প্রতিরোধ করা, যার সমালোচনা তিনি বারবার করেছেন।
আমরা এখনও জানি না, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কতটা ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাথমিক সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ট্রাম্পের প্রধান লক্ষ্য—ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা—তা অর্জিত হয়নি। ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো “সম্পূর্ণ ধ্বংস” হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোর্দোসহ কিছু স্থাপনায় গুরুতর ক্ষতি হলেও এগুলো ধ্বংস হয়নি।
তার চেয়েও উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, বিশ্লেষকরা বলছেন ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রাংশ আগেই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি ১৪টি ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা ও ৩০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উপাদানগুলো অক্ষত রয়ে গেছে, যা দেশটির লক্ষ্য কিছুটা পিছিয়ে দিলেও থামায়নি—এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে. ডি. ভ্যান্স নিজেও।
ট্রাম্পের এই সামরিক পদক্ষেপ বরং ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করতে পারে। রবিবারের হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিল, ইরান কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দিক থেকে এখনো কয়েক বছর দূরে, এবং অস্ত্রীকরণের দিকে তারা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল না। সে সময়ে আমেরিকানদের জন্য কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি ছিল না।
কিন্তু এখন ইরানের নেতাদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারও কূটনৈতিক আলোচনায় ফিরে যাওয়ার কোনো প্রণোদনা নেই। ট্রাম্প এরই মধ্যে দুইবার আলোচনার পথ ধ্বংস করেছেন—প্রথমে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানকে অনুমোদন দিয়ে, এরপর ১০ দিন পর সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকেও যুদ্ধে জড়িয়ে নিয়ে। ইরান এখন হয়তো মনে করছে, কেবল নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশও হয়তো এই উপসংহারে পৌঁছাবে, যা ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে চলা যুক্তরাষ্ট্রনেতৃত্বাধীন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নীতিকে চরমভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এইভাবে ট্রাম্পের ইরানকে থামানোর চেষ্টা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ার পথ খুলে দিতে পারে।
আসন্ন সময়ে ট্রাম্পের এই সামরিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও বিপজ্জনক হতে পারে। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, এই হামলা ছিল এককালীন, তবুও মার্কিন-ইরান যুদ্ধ আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ইরানের নেতারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যেতে পারেন। ৪০ হাজার মার্কিন সেনা যাঁরা ওই অঞ্চলে রয়েছেন, তারা টার্গেট হতে পারেন, এবং তাদের ওপর হামলা হলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
ইরান প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অন্যান্য পথেও হাঁটতে পারে—যেমন হরমুজ প্রণালির জাহাজ চলাচল ব্যাহত করা (যার হুমকি ইতিমধ্যে তারা দিয়েছে), বা সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো। ইরানের ঘনিষ্ঠ সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা আবার লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা শুরু করতে পারে, যার ফলে ছয় সপ্তাহের অস্ত্রবিরতি ভেঙে যাবে। এসব পদক্ষেপই যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে—যে ধরনের যুদ্ধ এড়ানোর প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প নিজেই দিয়েছিলেন।
এই ইরান হামলা ট্রাম্পের অন্য বৈদেশিক অগ্রাধিকারের প্রতিও হুমকি তৈরি করেছে। এখন কূটনৈতিকভাবে ইরানকে চুক্তিতে আনাটা অসম্ভব বলেই ধরে নেওয়া যায়, কারণ ইরানের নেতারা ট্রাম্পের কথায় আর আস্থা রাখতে পারছেন না। বিশ্বের অন্য নেতারাও হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাবেন, ফলে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ট্রাম্পের প্রচেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন হয়তো মনে করবেন, যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার ট্রাম্পের আশ্বাসও অবিশ্বাস্য।
এশিয়ার পর্যবেক্ষকদের কাছে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো—এশিয়া-কেন্দ্রিক আমেরিকার পুনঃকেন্দ্রীকরণ পরিকল্পনার অনির্দিষ্ট বিলম্ব। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের মিত্র রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতেই পারে এবং নিজেদের নিরাপত্তা কৌশল পুনর্বিন্যাস করতে পারে, বিশেষ করে যদি এই যুদ্ধ ট্রাম্প যেভাবে বলছেন, এককালীন না হয়ে দীর্ঘায়িত হয়।
ট্রাম্প তার সামরিক পদক্ষেপের পরিণতি এড়াতে পারবেন না, তবে তিনি চাইলে ভবিষ্যতের ক্ষতি কমাতে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন।
প্রথমত, তার উচিত ইরানকে আরও হামলার হুমকি না দেওয়া। যদি ইরান মনে করে, আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, তবে তারা আরও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা উচিত, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে না। সেই বার্তা সমর্থন করতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো বিমান ও নৌবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়ে। এতে উত্তেজনা প্রশমনের সংকেত যাবে এবং ইরান ও আমেরিকার জনগণ বুঝতে পারবে, ট্রাম্প একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চান না।
ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে দাবি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। যদি তিনি সত্যিই সেই ভাবমূর্তি রক্ষা করতে চান, তাহলে সামনে কিছুদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কি এক নতুন দিক পরিবর্তনকারী নেতা হয়ে উঠবেন, নাকি আরও একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবেন যিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি অপচয় করেছেন?
লেখক: জেনিফার ক্যাভানাহ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদেশনীতি-সম্পর্কিত থিঙ্ক ট্যাংক ‘ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ’-এর সামরিক বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক এবং সিনিয়র ফেলো।