যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল হামলার জবাবে ইরানের হুমকি
গত সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার-বাস্টার বোমা হামলা চালানোর পর সোমবার ভোরে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ভয়াবহ আকাশ হামলা শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসল ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করতে আরও সময় লাগবে। এ অবস্থায় ইরান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ঘাঁটিগুলোর ওপর প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে।
মার্কিন নাগরিকদের জন্য বিশ্বজুড়ে সতর্কতা
ইরানের হুমকির প্রেক্ষিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বজুড়ে তাদের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর বিক্ষোভ ও হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। কাতারে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস স্থানীয় আমেরিকানদের ঘরে অবস্থান করতে আহ্বান জানিয়েছে।
তেহরানের ওপর ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত
ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ করতে হামলা চালিয়েছে। তেহরানে ইভিন কারাগারেও ইসরায়েলি বোমা পড়েছে বলে জানানো হয়েছে, যেখানে অনেক রাজনৈতিক বন্দী রয়েছে। এই হামলাকে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছেন ইরানে আটক ফরাসি নাগরিকের বোন।
ইরান বলছে, ইসরায়েলি হামলায় কারাগার ক্ষতিগ্রস্ত
ইরানের বিচার বিভাগ জানিয়েছে, ইভিন কারাগারে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণের কারণে কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
আইএইএ-এর উদ্বেগ ও তেহরানে ফের পরিদর্শন চাওয়া
জাতিসংঘ পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ-এর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি ইরানে ফের পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দাবি করেছেন। তার মতে, ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের হিসাব রাখা জরুরি।
তেল দামে অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় তেলের দাম সোমবার সকালেই ৪ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। তবে পরে আবার সামান্য কমে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান সতর্ক করেছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তা চরম বিপজ্জনক হবে।
চীন ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
চীন বলেছে, হরমুজ প্রণালীসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধ এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাজ করতে হবে। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং আক্ষেপ প্রকাশ করেছে।
ইরানের পাল্টা হামলার হুমকি
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, এই শত্রুতামূলক হামলার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ঘাঁটিগুলো বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে এবং যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হবে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছে, সেগুলোও টার্গেট হবে।
ইসরায়েলের সশস্ত্র অভিযান এবং প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা তেহরান ও অন্যান্য শহরের সামরিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এবং নজরদারি কেন্দ্র লক্ষ্য করে একাধিক হামলা চালিয়েছে। তেহরানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে এএফপি জানিয়েছে।
জেরুজালেমে বিস্ফোরণ ও সাইরেন
সোমবার জেরুজালেমসহ বিভিন্ন এলাকায় ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর সাইরেন বেজে ওঠে। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী জানায়, জনগণ আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের অবস্থান
অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পক্ষে অবস্থান নিলেও “সম্পূর্ণ যুদ্ধ” এড়াতে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। ফ্রান্স ইসরায়েল থেকে নাগরিক সরিয়ে নিতে সামরিক বিমান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
উত্তর কোরিয়া ও ইরানের অভিযোগ
উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানিয়েছে। ইরান বলছে, পারমাণবিক আলোচনার মধ্যেই এই হামলা হয়েছে, যা কূটনীতির বিশ্বাসঘাতকতা।
ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্ববাজারে চরম জ্বালানি সংকট দেখা দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এই পথ বন্ধ করলে ইরান নিজের অর্থনৈতিক আত্মহননের পথ বেছে নেবে।
ট্রাম্পের বক্তব্য
ট্রাম্প বলেছেন, “আমরা তাদের হাত থেকে বোমা কেড়ে নিয়েছি। তারা সুযোগ পেলে ব্যবহার করতই।” তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাফল্য ছিল বিস্ময়কর এবং গভীরস্থ পারমাণবিক ঘাঁটিতেও সফল আঘাত হানা হয়েছে।
উপসংহার
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে বিস্তৃত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা বাড়ছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিক সমাধানের তাগিদ দিচ্ছে, তবে মাঠের বাস্তবতায় যুদ্ধের শঙ্কাই বড় হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা বিশ্বজুড়ে এখন নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। পরিস্থিতি কখন কোন দিকে মোড় নেয়, তা এখনো অনিশ্চিত।