আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের প্রাক্কালে চীনের প্রতিবেদন
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী ও অবৈধ মাদক পাচার প্রতিরোধ দিবসের আগের দিন চীন প্রকাশ করেছে ২০২৪ সালের ‘চীনের মাদক পরিস্থিতি’ রিপোর্ট। এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশটির মাদক পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটেছে এবং বিশেষ করে ‘ফেন্টানিল জাতীয় পদার্থের উল্লেখযোগ্য অপব্যবহারের কোনো প্রমাণ নেই’।
একই দিনে চীনের জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কার্যালয় জানিয়েছে, চীন ইতোমধ্যে ‘নাইটাজিন’ সহ ১২ ধরনের নতুন সাইকোঅ্যাকটিভ পদার্থকে নিয়ন্ত্রিত মাদকের তালিকাভুক্ত করেছে।
ফেন্টানিল ও নাইটাজিন: যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর কারণ
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে সিনথেটিক ওপিওয়েড (বিশেষ করে ফেন্টানিল) লাখ লাখ আমেরিকানের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। শুধু ২০২৩ সালেই, ওষুধ অতিরিক্ত গ্রহণে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার আমেরিকানের; এর মধ্যে প্রায় ৭৩ হাজার মৃত্যু ঘটেছে সিনথেটিক ওপিওয়েডের কারণে, যা মোট মৃত্যুর ৬৯ শতাংশ।
যদিও ‘নাইটাজিন’ এখনো ফেন্টানিলের তুলনায় কম ব্যবহৃত, তবুও তার অতিশয় বিষক্রিয়াশীলতা এবং প্রাণঘাতী ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রে আইনপ্রয়োগকারী ও স্বাস্থ্যসেবাদানকারী মহলে মারাত্মক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দোষারোপ নীতি ও চীনের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্র তাদের ফেন্টানিল সংকটের জন্য বহিরাগত সরবরাহ শৃঙ্খলকে দায়ী করলেও চীনের এই প্রতিবেদন পরিস্থিতির এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে। দুই দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী আলোচনার দাবি রাখে।
চীন সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণকে জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
২০১৯ সালে চীন ফেন্টানিল সংশ্লিষ্ট সব পদার্থকে অ-চিকিৎসাগত উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত মাদক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আইন সংশোধন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। পুলিশ, কাস্টমস ও ডাক বিভাগ দেশজুড়ে নজরদারির ব্যবস্থা আপগ্রেড করে। এ থেকেই চীনের কঠোর অঙ্গীকার ও সমন্বয় ক্ষমতা স্পষ্ট হয়।
“সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ” মডেল: চীনা দূরদর্শিতা ও আন্তর্জাতিক বার্তা
নতুন সাইকোঅ্যাকটিভ পদার্থ নিয়ন্ত্রণে চীনের ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ মডেল বিশ্ববাসীর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। এটি চীনের “সমাধান” এবং “জ্ঞান” হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এই উদ্ভাবনী ও সক্রিয় পন্থা বৈশ্বিক মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
এ সফলতার পেছনে কোনও গোপন প্রযুক্তি নয়, বরং রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতা ও অজুহাত
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন: ফেডারেল কাঠামোর কারণে মাদক নীতিতে রাজ্যভেদে বৈষম্য—কোনও রাজ্যে গাঁজা বৈধ, আবার অন্য কোথাও কঠোর শাস্তির বিধান। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ অজুহাত হতে পারে না।
আশ্চর্যজনকভাবে, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র হাজার হাজার অফিসার, সামরিক সহায়তা, অস্থায়ী বন্দিশিবির এবং রাজ্য-সরকার সমন্বয় জোরালোভাবে কার্যকর করে—ঠিক সেই ধরনের প্রয়াস ফেন্টানিল নিয়ন্ত্রণে দেখা যায় না।
২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে অভিবাসন ও সীমান্ত সুরক্ষায়, অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা DEA-এর বরাদ্দ মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, ফেন্টানিল সংকট দমন যদি সমান গুরুত্ব পেত, তাহলে আজ এর পরিণাম এত ভয়াবহ হতো না।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব
সবশেষে বিষয়টি দাঁড়ায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের অপব্যবহারে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতি বছর, কিন্তু এই সংকট যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।
প্রশ্ন রয়ে যায়: যুক্তরাষ্ট্র সরকার কি চীনের মতো মাদক নিয়ন্ত্রণকে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে দেখতে প্রস্তুত? নাকি শুধুই দায় এড়িয়ে অন্য দেশকে দোষারোপ করেই সন্তুষ্ট?
বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যর্থতা গভীর আত্মসমালোচনার দাবি রাখে।
চীনের মাদক নিয়ন্ত্রণে সাফল্য একদিকে অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও দ্রুত বাস্তবায়নের পরিচয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব বিশ্বব্যাপী মাদক সংকট মোকাবেলায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
( তথ্য সূত্র: গ্লোবাল টাইমস)