ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতি, কিন্তু টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন
২০২৫ সালের ২৪ জুন ওয়াশিংটন, তেল আবিব ও ইস্তানবুল থেকে পাঠানো একাধিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এই হামলা কেবলমাত্র কয়েক মাসের জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পিছিয়ে দিতে পেরেছে। এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি দুর্বল অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়েছে।
দুই দেশের বিজয় দাবি ও বিভ্রান্তি
১২ দিনের সংঘাত শেষে ইরান ও ইসরায়েল ঘোষণা করে যে, তারা যুদ্ধ থামিয়েছে। ট্রাম্প সমালোচনার সুরে বলেন, তারা তাঁর ঘোষিত অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘন করেছে। উভয় দেশ নিজেদের বিজয় দাবি করেছে। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে “সম্পূর্ণ ধ্বংস” করেছে। কিন্তু ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইরানের অনেক ইউরেনিয়াম মজুদ এখনো অক্ষত এবং স্থাপনাগুলোর ভেতরের কাঠামো ধ্বংস হয়নি, শুধু প্রবেশপথ বন্ধ হয়েছে।
গোয়েন্দা রিপোর্ট বনাম হোয়াইট হাউসের অবস্থান
হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, এই মূল্যায়ন “একেবারেই ভুল”। তবে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, কিছু সেন্ট্রিফিউজ এখনো সচল রয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধিরা বলেন, হামলা ইরানের কর্মসূচিকে “দুর্বল” করেছে, কিন্তু “ধ্বংস” করেনি।
নেতানিয়াহু ও পেজেশকিয়ানের বক্তব্য
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, “ইরানকে পরমাণু বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে,” এবং তিনি ইরানের অস্ত্র পুনরায় নির্মাণে বাধা দেওয়ার সংকল্প প্রকাশ করেন। অন্যদিকে ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এটিকে “বিরাট বিজয়” বলে আখ্যা দিয়ে জানান, তারা যুদ্ধ শেষ করতে পেরেছে। তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতপার্থক্য দূর করতে প্রস্তুত।
যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৩ জুনে ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় এবং দেশটির শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে। এটি ১৯৮০’র দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ইরানের সর্ববৃহৎ ক্ষতি। ইরানও পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি ও শহরে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
যুদ্ধ শেষ, কিন্তু অস্থিরতা অব্যাহত
যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী দেশজুড়ে কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর পুনরায় চালু হয়। একইভাবে ইরানও তার আকাশপথ খুলে দেয়।
হোয়াইট হাউস জানায়, অস্ত্রবিরতি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর আলোচনার মাধ্যমে হয়েছে এবং ইরানের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগও ছিল। তবে এই অস্ত্রবিরতি কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
দুই পক্ষের সন্দেহ ও অসন্তোষ
ইসরায়েল ও ইরান পরস্পরকে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। ট্রাম্প কড়া ভাষায় ইসরায়েলকে বলেছেন, “শান্ত হও।” তিনি দাবি করেন, তাঁর নির্দেশেই ইসরায়েল পরবর্তী হামলা বন্ধ করে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ জানান, ইরান যদি অস্ত্রবিরতি মানে, তবে তারাও মানবে।
ইরানও একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে একে অপরের প্রতি গভীর অবিশ্বাস এই অস্ত্রবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে।
সামরিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান আয়াল জামির বলেন, “এই সংঘাতের একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে, কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান শেষ হয়নি।” এখন তাদের লক্ষ্য গাজায় হামাসবিরোধী যুদ্ধ।
ইরানও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে “বেদনাদায়ক শিক্ষা” দেওয়া হয়েছে বলে হুঁশিয়ার করে।
প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ৬১০ জন নিহত ও ৪৭৪৬ জন আহত হয়েছে। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে ২৮ জন মারা গেছে। এই প্রথমবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বড় আকারে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করেছে।
এই অস্ত্রবিরতির ফলে তেলের মূল্য হঠাৎ পড়ে যায় এবং বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ইতিবাচক সাড়া দেখা যায়, যা উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে তেলের সরবরাহে স্থিতিশীলতা ফিরবে বলে আশা জাগায়।
ট্রাম্পের অস্বাভাবিক মন্তব্য
সকালে হোয়াইট হাউস ছাড়ার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলের ওপর ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন, “তাদের শান্ত করতে হবে। ওরা এতদিন ধরে যুদ্ধ করছে যে নিজেরাও জানে না কী করছে।” অস্ত্রবিরতির পরও ইসরায়েলের রাডার স্থাপনায় হামলা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, কারণ তারা জানায়, হামলা ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিক্রিয়ায় হয়েছিল।
ইরান দাবি করে, তারা কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়েনি এবং ইসরায়েলের হামলা অস্ত্রবিরতির এক ঘণ্টা পরও চলেছে।
একটি সাধারণ নাগরিকের উপলব্ধি
৩৮ বছর বয়সী রেজা শরিফি, যিনি পরিবার নিয়ে কাস্পিয়ান সাগরের রাস্তা থেকে তেহরানে ফিরছিলেন, বলেন, “যুদ্ধ শেষ। এটা কখনো শুরুই হওয়া উচিত ছিল না।”
এই সংঘাত ও অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রভাব আবারও আলোচনায় আসে; কিন্তু ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি স্থাপন এখনো বহু দূরের পথ। তেলের সরবরাহ, আঞ্চলিক উত্তেজনা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনা এখন তুঙ্গে।