একটি নেতৃত্ব, তিনটি প্রবণতা
জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ আহ্বান ১৯৭৫ সালে ভারতের জরুরি অবস্থার আগমুহূর্তে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আজ সেই জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পর, নতুন গবেষণা ও বইপত্র আরও আলো ফেলছে ১৯৭০-এর দশকের সেই অন্ধকার অধ্যায়ে। এই সময়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী—যিনি একদিকে ১৯৭১-এ ছিলেন ‘দুর্গা’, ১৯৭৫-এ স্বৈরশাসক, আবার ১৯৭৭-এ স্বৈরশাসক হয়েও নির্বাচন ডেকে গণতন্ত্রের এক নতুন রূপ দেখিয়েছিলেন—সবকিছু মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে।
১৯৭১: দুর্গার রূপ
পাকিস্তানকে ভাগ করে বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকার জন্য তার বিরোধী নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী তাকে ‘দুর্গা’ উপাধি দেন। নতুন গঠিত পাকিস্তান-চীন-আমেরিকা জোটের মোকাবেলায় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বচুক্তি করেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পাঠালেও তিনি পিছপা হননি।
একটি গল্প আছে, ১৪ বছর বয়সে সিলোনে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) একবার জিপে ভ্রমণের সময় দুর্ঘটনার মুখে পড়লে তিনি ঠান্ডা মাথায় দ্রুত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামেন। তার বাবা জওহরলাল নেহরু তখন রেগে গেলেও ইন্দিরা শেখেন—সংকটে ধৈর্য হারানো চলবে না। এই অভ্যাস ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় কাজে আসে।
১৯৭৩-৭৪: সংকট ও বিরোধিতার উত্থান
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ভারতের মূল্যস্ফীতি চরমে ওঠে। এই পরিস্থিতি গুজরাটে ‘নব নির্মাণ আন্দোলন’ এবং পরে জয়প্রকাশ নারায়ণ নেতৃত্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের জন্ম দেয়। এই আন্দোলনগুলি ইন্দিরার পদত্যাগ দাবি করে এবং বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করে।
১৯৭৫: গণতন্ত্র নয়, শৃঙ্খলাই মুখ্য
এই সময়েও ইন্দিরা গান্ধী ধৈর্য রাখলেও তার ‘শৃঙ্খলা আগে, গণতন্ত্র পরে’ প্রবণতা সক্রিয় ছিল। তার জীবনীকার ক্যাথরিন ফ্র্যাঙ্ক লিখেছেন, ইন্দিরার মধ্যে নেহরুর মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল না। ১৯৫৯ সালে কেরালার কমিউনিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে নেহরুকে বাধ্য করেছিলেন তিনিই।
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন রাতে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিনহা তাকে নির্বাচনী দুর্নীতির কারণে সাংসদ পদ থেকে অপসারণের ১৩ দিন পর তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেন। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে সেই চিন্তা ত্যাগ করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার সময় মন্ত্রিসভার কোনো বৈঠক ডাকেননি, রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমদ বিনা প্রশ্নে সই করে দেন। তারপর একে একে বিরোধী নেতাদের (জেপি, বাজপেয়ী, আদবানি, চরণ সিং, চন্দ্রশেখর প্রমুখ) গ্রেপ্তার করা হয়। হাজারো রাজনৈতিক কর্মীকেও বন্দি করা হয়।
তাদের পরিবার মাসের পর মাস জানতেই পারেনি, তারা কোথায় আছে। অনেকের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠে। এরপর যা ঘটে তা ইতিহাস—মৌলিক অধিকার স্থগিত, সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ, সংবিধান সংশোধন, নির্বাহী ক্ষমতা বাড়ানো এবং বিচার বিভাগের দুর্বলতা।
সঞ্জয় গান্ধী ও ‘বিকল্প সরকার’
এই সময়েই শুরু হয় সঞ্জয় গান্ধীর অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব। গণহারে জোরপূর্বক জন্মনিয়ন্ত্রণ অপারেশন এবং চারটি রাজ্যে সংবিধান সভা গঠনের প্রস্তাব—সবই ছিল তার ছায়াশাসনের প্রতিফলন।
১৯৭৬ সালে মুম্বাইয়ে ‘হিম্মত’ পত্রিকায় কাজ করার সময় লেখিকা দেখেছেন, কেমন করে ছোট পত্রিকাগুলি ইন্দিরার কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ‘হিম্মত’ প্রথমে স্ব-নিয়ন্ত্রণে চলে, তারপর কর্তৃপক্ষের অভিযোগে পূর্ণ সেন্সরের শিকার হয়। প্রেসগুলোতে চাপ প্রয়োগ করে ছাপা বন্ধ করে দেওয়া গিয়েছিল। তখন সম্পাদক রাজমোহন গান্ধী অর্থ সংগ্রহের আবেদন করেন এবং ৬০,০০০ টাকা জমিয়ে তারা নিজের প্রেস কিনে নেয়।
১৯৭৭: ‘স্বৈরশাসক’ নিজেই ডাকলেন নির্বাচন
এই সময়েই আসে সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায়—ইন্দিরা গান্ধী নিজেই ১৯৭৭ সালের মার্চে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন, যদিও কোনো আন্তর্জাতিক চাপ ছিল না। এই নির্বাচনে কংগ্রেস উত্তর ভারতে ভরাডুবি করে। পরে তিনি স্বীকার করেন—তার শাসনে বাড়াবাড়ি হয়েছে।
সঞ্জয় এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বংশী লাল বিরোধিতা করেছিলেন নির্বাচন আহ্বানের, বলেছিলেন, “আমাদের দিদিকে আজীবন রাষ্ট্রপতি করে দাও, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।” কিন্তু ইন্দিরা তখন নিজের দলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিলেন। সঞ্জয় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন, যার কারণে তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা ফেরাতে চেয়েছিলেন এবং সঞ্জয়কে ভবিষ্যতের উত্তরসূরি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
উত্তরাধিকার ও প্রশ্ন
কেন তিনি এই নির্বাচন ডাকলেন—এ নিয়ে বিতর্ক আজও চলে। তিনি কি নেহরুর কন্যা হিসেবে গণতন্ত্রমুখী ছিলেন, নাকি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন ফিরে পেতে চেয়েছিলেন? না কি জে. কৃষ্ণমূর্তির প্রভাবে কোনো আধ্যাত্মিক তাগিদ কাজ করেছিল? না কি আসল লক্ষ্য ছিল সঞ্জয়কে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা?
তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, নির্বাচন তাকে আবার সরকারে দৃঢ় অবস্থান এনে দেবে। সে সময় তিনি বিরোধী দলগুলোর কিছু নেতাকে ‘নরম’ করেছিলেন এবং ভাবেন, জয় পাওয়া যাবে। কিন্তু মুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই বিরোধীরা একত্রিত হয়ে জনতা পার্টি গঠন করে এবং জগজীবন রাম কংগ্রেস ছাড়েন, যা ইন্দিরার পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটায়।
শক্তি ও রাজনৈতিক পদ্ধতির রূপান্তর
ইন্দিরা গান্ধী—তিনি হোক দুর্গা, স্বৈরশাসক, কিংবা গণতন্ত্রের উপস্থাপক—ক্ষমতা ধারণ ও প্রয়োগের কৌশল খুব ভালো বুঝতেন। পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিকরা তার ‘সাম, দাম, দণ্ড, ভেদ’ কৌশল অনুকরণ করেন—যার ফলে রাজনীতি থেকে প্রতিষ্ঠানবাদ ও মতবাদ উভয়ই ক্ষয়ে যেতে থাকে।
ইন্দিরা গান্ধী এবং (সমসাময়িক উদাহরণ হিসেবে) নরেন্দ্র মোদী দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যত বেশি শক্তিশালী, ও জনপ্রিয় হন, তত বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাপে পড়ে। আর নেতৃত্ব দুর্বল হলে—যেমন জোট সরকারের সময় দেখা গেছে—ততই ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর থাকে।