যুদ্ধের উত্তাপে চীন-রাশিয়া সংলাপ
জুনের ১৯ তারিখ, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর ছয় দিন পর, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। পুতিন তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি অর্থনৈতিক ফোরামে ছিলেন। উভয় নেতাই সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
রাশিয়া মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিতে প্রস্তুত বলে জানান পুতিন। শি জিনপিং, যিনি অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি ক্রেতার প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের মতো মন্তব্য করেন—এই সংঘাত আবারও প্রমাণ করছে, বিশ্ব এক নতুন অস্থিরতা ও রূপান্তরের যুগে প্রবেশ করছে।
তবে ইরানকে সমর্থনের বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপের উল্লেখ ছাড়াই আলোচনার গতি ঘুরে যায় অন্য বিষয়ে: বৈশ্বিক বাণিজ্য, জি-সেভেন সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অংশগ্রহণ এবং এসসিও ও ব্রিকসের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি।
সংকটে চীন-রাশিয়ার অনুপস্থিতি
হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক জিনেব রিবুয়া বলেন, এসসিও ও ব্রিকস মূলত যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে তৈরি হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়ার মনোযোগ নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় নিবদ্ধ ছিল, তেহরানের পক্ষে নয়। তার মতে, এই অবস্থান বিশ্বজুড়ে নজরে পড়বে। ছোট দেশগুলোর কাছে নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করলেও সংকটকালে চীন-রাশিয়া পাশে দাঁড়ায়নি, যেমনটি সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল।
‘উপদ্রব অক্ষ’ ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে। চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে গঠিত কথিত ‘উপদ্রব অক্ষ’ (CRINK) নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছে।
ইরান ২০২৩ সালে এসসিওতে যোগ দেয় এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে সাংহাই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক গাও জিয়ান মনে করেন, এই সদস্যপদ মূলত প্রতীকী। এসসিও একটি সামরিক জোট নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে বেশি জোর দেয়।
চীনের কৌশলগত সংযোগ
২৬ জুন চীনের কিংদাও শহরে এসসিও বৈঠকের ফাঁকে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদে ও চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডং জুন সাক্ষাৎ করেন। এসসিওর বিবৃতিতে ইসরায়েলের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও বিশ্লেষক স্টিফেন ওলসন বলেন, এসব সংগঠন এখনো বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করেনি।
বাস্তব ‘অক্ষ’: নিষেধাজ্ঞা-পীড়িত দেশগুলোর সহযোগিতা
স্টিমসন সেন্টারের বিশ্লেষক কেলি গ্রিকো বলেন, ‘উপদ্রব অক্ষ’ মূলত ওয়াশিংটনের ধারণা মাত্র। এসব দেশের অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্র হলেও পারস্পরিক স্বার্থ বা রাজনৈতিক সংহতি দুর্বল। বরং তারা একে অপরের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করছে।
২০২০ সালে চীন ইরানের সঙ্গে ২৫ বছরের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করে। যদিও ২০২২ সালের পর চীনা শুল্ক তথ্য ইরানি তেল আমদানির তথ্য প্রকাশ করেনি, তবে মালয়েশিয়ার মাধ্যমে রি-লেবেল করে ইরানি তেল প্রবেশ করছে বলে ধারণা করা হয়।
চীন-ইরান বাণিজ্যের অনেক অংশই চীনা মুদ্রায় সম্পন্ন হচ্ছে, যা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে দুর্বল করছে। চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ একে ইউয়ান আন্তর্জাতিকীকরণের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ট্রাম্পের সামরিক কৌশল ও মার্কিন অবস্থান
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক পোস্টে বলেন, “চীন এখন ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।” অনেকেই এটিকে ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপের নীতির কিছুটা শিথিলতার ইঙ্গিত মনে করলেও হোয়াইট হাউজ পরে জানায়, মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ট্রাম্প আগামী সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সম্পর্ক
২০২৪ সালের জুনে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে একটি পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করে এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ সৈন্য পাঠায়। তবে গ্রিকোর মতে, এই সম্পর্ক কৌশলগত ও স্বল্পমেয়াদি। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়ার কাছে উত্তর কোরিয়ার গুরুত্ব কমে যাবে।
ট্রাম্প নীতির প্রকাশ: ‘তিন ধাপের কৌশল’
যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ওহাইওতে রিপাবলিকান পার্টির এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখা তুলে ধরেন:
১. যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ স্পষ্ট করা (যেমন—ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র না পায়)।
২. কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান চেষ্টা।
৩. কূটনীতি ব্যর্থ হলে, চূড়ান্ত সামরিক শক্তি ব্যবহার করে তা সমাধান এবং দ্রুত সরে যাওয়া।
এই কৌশল ইসরায়েলের সামরিক সাফল্যের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার গ্রে। তিনি একে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আঞ্চলিক দায় ভাগাভাগির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে আশঙ্কা
এশিয়ার কূটনীতিকরা আশঙ্কা করছেন, এই নীতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও প্রয়োগ হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন তাইওয়ানকে তার জিডিপির ১০ শতাংশ প্রতিরক্ষায় ব্যয় করতে বলেছে। জাপানসহ অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গেও এই ব্যয় ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে।
একমাত্র শক্তিধর মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ
প্রাক্তন মার্কিন নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল গ্যারি রাফহেড বলেন, এই সংঘাত প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের মতো সংকটে সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতা রাখে। রাশিয়া ও চীন কোনো পক্ষকেই যুদ্ধ থামাতে বাধ্য করতে পারেনি, এমনকি চীন তার অর্থনৈতিক প্রভাবও কাজে লাগাতে পারেনি।
সার্বিকভাবে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতা তুলে ধরেছে যেখানে চীন ও রাশিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছে, এবং একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই এখনো এমন সংঘাত নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।