০৮:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির ভাঙার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৬) চিতা-বাঘের শেষ আলোঝলক ঢাকা শহরের বাস সেবা: আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা ইরান ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে? মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ও গঙ্গা জলচুক্তি নবায়ন নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের বড় একটি ভুল, প্রতিশোধ বনাম সংস্কার সাকিব আল হাসান: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক অমর কিংবদন্তি বাংলা নাটকের সুপারস্টার অপূর্বের জন্মদিন আজ

জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে?

  • Sarakhon Report
  • ০৪:৫৫:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
  • 9

“আমি তো ভাবতেই পারিনি যে পূর্ব কলকাতায় আমার ফ্ল্যাটে বসে সরাসরি জগন্নাথধামের প্রসাদ পেয়ে যাব। এত আনন্দ হয়েছে আমার, কী বলব। সেদিন আমাদের বাড়িতে যত মানুষ এসেছেন, সবাইকে অল্প অল্প করে প্রসাদ দিয়েছি,” কথাগুলো বলছিলেন শুভ্রা মুখার্জি।

ওই একই রকম বাক্স পৌঁছিয়েছে কলকাতার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্যর বাড়িতেও।

তিনি বলছিলেন, “ওইরকম বাক্স যে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা আগেই জানতাম। তো সেদিন আমার বাড়িতেও এল। আমি এই সরকারি অর্থে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ আর প্রসাদ বিতরণের নীতিগত বিরোধী, এ নিয়ে সমাজ মাধ্যমে লিখেওছি। তাই আমি ওই প্রসাদ মুখে দিইনি।”

আবার মুর্শিদাবাদের সংবাদকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, “আমি আজ রেশন নিতে গিয়েছিলাম। তো সেখানেই এই বাক্সটি দেওয়া হলো। এখনও খুলে দেখিনি যে কী আছে ভেতরে।”

এরকমই বাক্স পশ্চিমবঙ্গের এক কোটিরও বেশি পরিবারের কাছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর তরফে পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা জগন্নাথের প্রধান উৎসব রথযাত্রা ২৭শে জুন। তার কদিন আগে থেকেই ‘জগন্নাথধাম মহাপ্রসাদ’ লেখা বাক্স বিতরণ করা হচ্ছে।

হিন্দুদের এই তিন দেবদেবী একই সঙ্গে, একই মন্দিরে পূজিত হন। এই তিন দেবদেবীর প্রধান মন্দিরটি ওড়িশার সৈকত শহর পুরীতে। তবে কয়েক মাস আগে, সেই প্রাচীন মন্দিরের আদলে পশ্চিমবঙ্গের সৈকত শহর দীঘাতেও একটি জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয়েছে।

রাজ্য সরকারেরই একটি সংস্থা ওই মন্দিরটি নির্মাণ করেছে, তবে ওই স্থাপনাটিকে ‘সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নাম দেওয়া হয়েছে।

‘জগন্নাথধাম দিঘা’র পরিচালন বোর্ডে সক্রিয়ভাবে রয়েছে ইসকনের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি।

ওই সৈকত শহরটির নামের প্রচলিত বানান দীঘা, তবে এই মন্দিরটির ক্ষেত্রে সরকার বানানটি লিখেছে ‘দিঘা’ হিসেবে।

মন্দির নির্মাণ এবং এখন প্রসাদ বিতরণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আলোচনা চলছে বেশ।

'জগন্নাথধাম' থেকে যে প্রসাদের বাক্স পাঠানো হচ্ছে
‘জগন্নাথধাম’ থেকে যে প্রসাদের বাক্স পাঠানো হচ্ছে

প্রসাদের বাক্স

‘জগন্নাথধাম দিঘা’ ও ‘জগন্নাথধাম মহাপ্রসাদ’ লেখা যে বাক্সগুলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, তার ভেতরে থাকছে দুটি করে মিষ্টি এবং তিন হিন্দু দেবদেবী – জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের একটি ছবি। ওই ছবির নিচে রয়েছে মমতা ব্যানার্জীর সই।

এই বাক্স বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলি করা হচ্ছে। এই রেশন ব্যবস্থা হলো স্বল্পমূল্যে নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করার প্রকল্প।

এছাড়া অনেক এলাকাতেই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কর্মীরাও এলাকায় ওই বাক্স বিলি করছেন।

মন্দির ট্রাস্ট বলছে যে প্রায় এক কোটি প্রসাদের বাক্স দীঘার জগন্নাথ ধাম থেকে পাঠানো হয়নি। প্রায় তিনশো কিলোগ্রাম মিষ্টি সেখানে দেব-দেবীদের প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তারপর সেগুলিই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয় মিষ্টির দোকানগুলোয় ওই প্রসাদ কিছুটা মিশিয়ে তৈরি হয়েছে যেসব মিষ্টি, সেটাই বাক্সে ভরে বাড়ি-বাড়ি বিলি করা হচ্ছে।

যারা ওই প্রসাদের বাক্স পেয়েছেন, তারা বলছেন যে দুটি মিষ্টির মধ্যে একটি হলো সন্দেশ বা প্যাড়া জাতীয় মিষ্টি, অন্যটি গজা।

এক কোটিরও বেশি বাড়িতে প্রসাদ পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে
এক কোটিরও বেশি বাড়িতে প্রসাদ পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে

এটা কি আদৌ প্রসাদ?

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্য বলছিলেন, “আমার বাড়ির নিচে একজন দন্ত চিকিৎসকের চেম্বার আছে। তার কাছেই রেখে দিয়ে গিয়েছিল এই বাক্স। ব্যক্তিগতভাবে জানি তিনি এবং তার পরিবার রাজ্য সরকারের অনেক কাজেরই সমালোচনা করে থাকেন। তবে তিনি যখন আমাদের বাড়ির জন্য রাখা বাক্সটি দিলেন, তিনি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিন্তু দেখাননি।”

“আবার আমি সরকারি অর্থে জগন্নাথ ধাম নির্মাণ বা প্রসাদ বিলির নীতিগত বিরোধী, তাই নিজে খাইনি ওই মিষ্টি। আমাদের বাড়িতে ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং ছেলে খেল। তারাও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল না,” বলছিলেন মি. আচার্য।

তার কথায়, “এমন অনেককে দেখছি, যারা রাজ্য সরকারের কাজের সমালোচনা করে থাকেন, তাদের মধ্যেও সেরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিনি আমি। সবারই মনে হচ্ছে মমতা ব্যানার্জী একটা কিছু দিলেন।”

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর এই কৌশলকে তিনি রাজনৈতিক কৌশল বলেই মনে করেন।

তবে কলকাতা শহরেরই দুই বাসিন্দা সুস্মিতা সমাদ্দার মুখার্জী ও শুভ্রা মুখার্জী, যারা ওই জগন্নাথধামের প্রসাদ পেয়েছেন বাড়িতে বসে, তারা পুরো বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে চান না।

সুস্মিতা সমাদ্দার মুখার্জীর কথায়, “জগন্নাথদেবের প্রসাদ পেয়েছি এটাই বড় কথা। তাকে আমরা পুজো করি, ভগবান বলে মানি। তাই তার প্রসাদ পেয়েছি সেই বিশ্বাস থেকেই। এর মধ্যে রাজনীতি আছে কী না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। “

তবে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপি বলছে, যেভাবে স্থানীয়ভাবে তৈরি মিষ্টির সঙ্গে দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ মিশিয়ে বিলি করা হচ্ছে, তাকে আদৌ প্রসাদ বলা যায় না।

তারা এই প্রসাদের একটি বিকৃত নামও দিয়েছে, যার সঙ্গে আবার মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের খাদ্যাভ্যাস জড়িত।

বিজেপির অন্যতম রাজ্য মুখপাত্র কেয়া ঘোষ বলছিলেন, “আমি নিজে জগন্নাথ দেবের ভক্ত। বছরে অন্তত তিনবার আমি শ্রীক্ষেত্র পুরীতে যাই। কিন্তু এখানে মহাপ্রসাদ নামে তো ভাঁওতাবাজি করা হচ্ছে। কেন এই বুজরুকি?”

তবে প্রসাদ পেয়ে আপ্লুত কলকাতার বাসিন্দা শুভ্রা মুখার্জী।

“আমি এত আপ্লুত এই প্রসাদ পেয়ে যে এখানে যারা রাজনীতির রঙ চড়াচ্ছেন, মনে হয় না তারা ঠিক করছে,” বলছিলেন মিসেস মুখার্জী।

জগন্নাথের মূল ও প্রাচীন মন্দির ওড়িশার পুরীতে; সেখানকার সৈকতে বালু দিয়ে তৈরি জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি - ফাইল ছবি
জগন্নাথের মূল ও প্রাচীন মন্দির ওড়িশার পুরীতে; সেখানকার সৈকতে বালু দিয়ে তৈরি জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি – ফাইল ছবি

সাংস্কৃতিক কেন্দ্র না মন্দির?

দীঘার জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ এবং এপ্রিল মাসে সেটি উদ্বোধনের সময় থেকেই এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে।

সরকারি সংস্থা ‘হিডকো’ এই মন্দির নির্মাণ করেছে। তাই বিরোধিরা এবং অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন যে সংবিধান অনুযায়ী কোনো সরকার কোনো একটি ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে না।

রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস যুক্তি দেয় যে এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, “এটাকে যদি আপনি আক্ষরিক অর্থে একটা ধর্মীয় পীঠস্থান হিসাবে দেখান, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মুখ্যমন্ত্রী যে উদ্যোগটা নিয়েছেন, সেটা হলো ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানো। ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্কৃতি, পর্যটন ইত্যাদির একটা মিলনক্ষেত্র দীঘাতে উনি তৈরি করেছেন।”

“হিন্দু ধর্মের যে গোঁড়া মনোভাব আছে, সেই প্রথার বাইরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিন্দুধর্মের মূল মন্ত্র – সহনশীলতা, মুক্তচিন্তা – যে ভাবধারা কবীর, নানক বা চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবদের থেকে এসেছে, সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের কথাই ভেবেছেন মুখ্যমন্ত্রী,” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল।

বিজেপি নেত্রী কেয়া ঘোষের প্রশ্ন, “দীঘায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেটা উনি করেছেন, সেখানে কালচারাল সেন্টারের নাম করে উনি মন্দির বানাচ্ছেন কীসের জন্য? মন্দির নির্মাণ কি কোনো সরকারের কাজ? তারা তো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বানাবে, চাকরি দেবে, উন্নয়ন করবে। সেটা না করে আপনার আমার করের টাকায় নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করতে নেমেছেন।”

তার কথায়, “এই পুরোটাই রাজনীতি। তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে ২০২৬ এর ভোটে শুধুই তার ভোট ব্যাংকের ভরসায় জিততে পারবেন না।”

রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমানদের অধিকাংশই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক, এমনটাই মনে করে থাকেন প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকই।

বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে থাকে যে তার মুসলমান ভোট ব্যাংককে নিয়ে ‘তুষ্টিকরণের রাজনীতি করেন মমতা ব্যানার্জী’।

মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, তার বাঁয়ে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও একেবারে ডানে ইসকন কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস
মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, তার বাঁয়ে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও একেবারে ডানে ইসকন কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস

‘তুষ্টিকরণের’ অভিযোগ, ভারসাম্য রাখতেই জগন্নাথ?

দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের সময় থেকেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে এটা মমতা ব্যানার্জীর একটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। আগামী বছর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। তৃণমূল কংগ্রেস ইতোমধ্যে তিনবার জয়ী হয়েছে এবং চতুর্থবার সরকার গড়ার জন্য ভোটে লড়বে দলটি।

একদিকে তার সরকারের বিরুদ্ধে নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, অন্যদিকে আছে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগির অঙ্ক এবং তার বিরুদ্ধে বিজেপির তোলা ‘তুষ্টিকরণের রাজনীতি’র অভিযোগ।

তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র মনোজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, “তুষ্টিকরণের রাজনীতি কেন করবেন মমতা ব্যানার্জী? তিনি কালীঘাটের মন্দির থেকে সামান্য দূরে থাকেন – বাড়িতে কালীপুজো করেন। আবার গির্জা, জৈন মন্দির, গুরুদোয়ারা, মসজিদ সব জায়গাতেই যান তিনি। তাহলে কী করে কোনো একটি ধর্মের মানুষদের তুষ্ট করার কথা আসছে?”

“তবে এটাও তো প্রশ্ন যে স্বাধীনতার পর থেকে এতগুলো বছরে মুসলমান এবং দলিতদের কতটা উন্নয়ন করতে পেরেছে রাজনৈতিক দলগুলো? সরকারি চাকরিতে তারা কত শতাংশ? বিজেপি তো এই মানুষগুলোকে বাদ দিয়েই রাজনীতি করে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা এই শ্রেণির পাশে তো কাউকে একটা দাঁড়াতে হবে? সেজন্য মমতা ব্যানার্জী তাদের পাশে থাকেন,” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল।

পুরীর মন্দিরটি আদলেই নির্মিত হয়েছে দীঘার এই জগন্নাথ মন্দির
পুরীর মন্দিরটি আদলেই নির্মিত হয়েছে দীঘার এই জগন্নাথ মন্দির

পাঁচ শতাংশ ভোটের অঙ্ক

ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগির প্রশ্নে বিজেপি যেমন তুষ্টিকরণের রাজনীতির অভিযোগ তোলে মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে, তেমনই এটাও ঘটনা যে হিন্দু ভোটও তার দল অনেকটাই পেয়ে থাকে। আর সেই হিন্দু ভোটে গত কয়েক বছর ধরে বড়সড় ভাগ বসিয়েছে বিজেপি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন মুসলমানদের ভোট নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তৃণমূল কংগ্রেস, তবে হিন্দু ভোটের অংশ আরও বাড়াতে চাইছে তারা। সেজন্যই হিন্দু দেবতার মন্দির নির্মাণ এবং তাকে ঘিরে একটা বড় কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্য হিসাব দিচ্ছিলেন, “বর্তমানে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট মোটামুটিভাবে ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী মুসলমানরা যদি এ রাজ্যের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হন, তার প্রায় সব ভোটই তৃণমূল কংগ্রেস পায়। বাকি হিন্দু ভোটও কিন্তু ৩৭-৩৮ শতাংশ যায় তৃণমূলের দিকেই।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য ওয়াল সংবাদ পোর্টালের কার্যকরী সম্পাদক অমল সরকার বলছিলেন, “সর্বশেষ যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, তার ফলাফল অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে পাঁচ শতাংশের ফারাক আছে এবং এটা হচ্ছে অ-মুসলিম ভোট। বিজেপি মুসলমানদের ভোট চায়ও না। তাই অ-মুসলিম ভোটের এই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ শতাংশের ফারাকটা কমাতে চায় বিজেপি।”

“বিজেপির একটাই অ্যাজেন্ডা এখন–– যে হিন্দু ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পায়, তা ছয়-সাত শতাংশ ছিনিয়ে আনতে পারলেই বিজেপি জয়ের দিকে অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে তারা মনে করে,” বলছিলেন মি. আচার্য।

অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জীও চান যে ওই পাঁচ শতাংশ অ-মুসলিম, মূলত হিন্দু ভোট যাতে আরও বেশি সংখ্যায় তার দিকে আসে। সেজন্যই হিন্দু ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের দিকে তিনি নজর দিয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

অমল সরকারের কথায়, “এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে ভোটের দিকে তাকিয়ে, বিজেপির সঙ্গে হিন্দু ভোট-শেয়ারের ফারাকটা আরও বাড়াতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে রাজনীতি প্রথম কিন্তু মিশিয়ে ছিলেন, অন্তত এ রাজ্যে, বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনিই প্রথম রামনবমীকে রাজনীতির কারণে ব্যবহার করেন।”

“বছর কয়েক পরে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসও ওই রামনবমীকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিকভাবে। এখন যা দাঁড়িয়েছে, রাজ্যে রামনবমীর মিছিলের মধ্যে তৃণমূল নেতাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানের সংখ্যাই বোধহয় বেশি,” বলছিলেন মি. সরকার।

বিজেপি হিন্দুত্ববাদ নিয়ে, হিন্দু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা নিয়ে বিজেপি কখনোই লুকোছাপা করে না।

তবে ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে বামপন্থিরা বাদে অন্য যে দলই বিজেপির অনুকরণ করে হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করতে গেছে, তারা অসফলই থেকেছে।

অমল সরকারের কথায়, “২০২৬-এ কী হবে, তা বলা এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ছত্তিশগড়ের ভূপেশ বাঘেল বা মধ্যপ্রদেশের কমল নাথের মতো প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা বিজেপির থেকেও যেন বড় হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠেছিলেন। রাহুল গান্ধী একটা সময়ে নানা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরতে শুরু করেছিলেন। আবার দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও দেখেছি একই পথে চলতে। এই সকলেই কিন্তু বিজেপির অনুকরণ করে হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে গিয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন।”

জগন্নাথদেব এবং তার প্রধান উৎসব রথযাত্রার আগে নানা রাজনৈতিক প্রশ্ন যখন উঠছে, বিতর্ক চলছে, তার মধ্যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা শেয়ার করছেন:

“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব–হাসে অন্তর্যামী”

বিবিসি বাংলা

ঢাকার খিলক্ষেতের দুর্গা মন্দির ভাঙার অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাখ্যা

জগন্নাথ মন্দির আর প্রসাদ বিতরণ নিয়ে কেন রাজনৈতিক বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে?

০৪:৫৫:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

“আমি তো ভাবতেই পারিনি যে পূর্ব কলকাতায় আমার ফ্ল্যাটে বসে সরাসরি জগন্নাথধামের প্রসাদ পেয়ে যাব। এত আনন্দ হয়েছে আমার, কী বলব। সেদিন আমাদের বাড়িতে যত মানুষ এসেছেন, সবাইকে অল্প অল্প করে প্রসাদ দিয়েছি,” কথাগুলো বলছিলেন শুভ্রা মুখার্জি।

ওই একই রকম বাক্স পৌঁছিয়েছে কলকাতার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্যর বাড়িতেও।

তিনি বলছিলেন, “ওইরকম বাক্স যে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা আগেই জানতাম। তো সেদিন আমার বাড়িতেও এল। আমি এই সরকারি অর্থে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ আর প্রসাদ বিতরণের নীতিগত বিরোধী, এ নিয়ে সমাজ মাধ্যমে লিখেওছি। তাই আমি ওই প্রসাদ মুখে দিইনি।”

আবার মুর্শিদাবাদের সংবাদকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, “আমি আজ রেশন নিতে গিয়েছিলাম। তো সেখানেই এই বাক্সটি দেওয়া হলো। এখনও খুলে দেখিনি যে কী আছে ভেতরে।”

এরকমই বাক্স পশ্চিমবঙ্গের এক কোটিরও বেশি পরিবারের কাছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর তরফে পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা জগন্নাথের প্রধান উৎসব রথযাত্রা ২৭শে জুন। তার কদিন আগে থেকেই ‘জগন্নাথধাম মহাপ্রসাদ’ লেখা বাক্স বিতরণ করা হচ্ছে।

হিন্দুদের এই তিন দেবদেবী একই সঙ্গে, একই মন্দিরে পূজিত হন। এই তিন দেবদেবীর প্রধান মন্দিরটি ওড়িশার সৈকত শহর পুরীতে। তবে কয়েক মাস আগে, সেই প্রাচীন মন্দিরের আদলে পশ্চিমবঙ্গের সৈকত শহর দীঘাতেও একটি জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয়েছে।

রাজ্য সরকারেরই একটি সংস্থা ওই মন্দিরটি নির্মাণ করেছে, তবে ওই স্থাপনাটিকে ‘সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নাম দেওয়া হয়েছে।

‘জগন্নাথধাম দিঘা’র পরিচালন বোর্ডে সক্রিয়ভাবে রয়েছে ইসকনের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি।

ওই সৈকত শহরটির নামের প্রচলিত বানান দীঘা, তবে এই মন্দিরটির ক্ষেত্রে সরকার বানানটি লিখেছে ‘দিঘা’ হিসেবে।

মন্দির নির্মাণ এবং এখন প্রসাদ বিতরণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আলোচনা চলছে বেশ।

'জগন্নাথধাম' থেকে যে প্রসাদের বাক্স পাঠানো হচ্ছে
‘জগন্নাথধাম’ থেকে যে প্রসাদের বাক্স পাঠানো হচ্ছে

প্রসাদের বাক্স

‘জগন্নাথধাম দিঘা’ ও ‘জগন্নাথধাম মহাপ্রসাদ’ লেখা যে বাক্সগুলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, তার ভেতরে থাকছে দুটি করে মিষ্টি এবং তিন হিন্দু দেবদেবী – জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের একটি ছবি। ওই ছবির নিচে রয়েছে মমতা ব্যানার্জীর সই।

এই বাক্স বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলি করা হচ্ছে। এই রেশন ব্যবস্থা হলো স্বল্পমূল্যে নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করার প্রকল্প।

এছাড়া অনেক এলাকাতেই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কর্মীরাও এলাকায় ওই বাক্স বিলি করছেন।

মন্দির ট্রাস্ট বলছে যে প্রায় এক কোটি প্রসাদের বাক্স দীঘার জগন্নাথ ধাম থেকে পাঠানো হয়নি। প্রায় তিনশো কিলোগ্রাম মিষ্টি সেখানে দেব-দেবীদের প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তারপর সেগুলিই ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। স্থানীয় মিষ্টির দোকানগুলোয় ওই প্রসাদ কিছুটা মিশিয়ে তৈরি হয়েছে যেসব মিষ্টি, সেটাই বাক্সে ভরে বাড়ি-বাড়ি বিলি করা হচ্ছে।

যারা ওই প্রসাদের বাক্স পেয়েছেন, তারা বলছেন যে দুটি মিষ্টির মধ্যে একটি হলো সন্দেশ বা প্যাড়া জাতীয় মিষ্টি, অন্যটি গজা।

এক কোটিরও বেশি বাড়িতে প্রসাদ পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে
এক কোটিরও বেশি বাড়িতে প্রসাদ পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে

এটা কি আদৌ প্রসাদ?

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্য বলছিলেন, “আমার বাড়ির নিচে একজন দন্ত চিকিৎসকের চেম্বার আছে। তার কাছেই রেখে দিয়ে গিয়েছিল এই বাক্স। ব্যক্তিগতভাবে জানি তিনি এবং তার পরিবার রাজ্য সরকারের অনেক কাজেরই সমালোচনা করে থাকেন। তবে তিনি যখন আমাদের বাড়ির জন্য রাখা বাক্সটি দিলেন, তিনি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিন্তু দেখাননি।”

“আবার আমি সরকারি অর্থে জগন্নাথ ধাম নির্মাণ বা প্রসাদ বিলির নীতিগত বিরোধী, তাই নিজে খাইনি ওই মিষ্টি। আমাদের বাড়িতে ঠাকুর-দেবতার ব্যাপার নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং ছেলে খেল। তারাও কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাল না,” বলছিলেন মি. আচার্য।

তার কথায়, “এমন অনেককে দেখছি, যারা রাজ্য সরকারের কাজের সমালোচনা করে থাকেন, তাদের মধ্যেও সেরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিনি আমি। সবারই মনে হচ্ছে মমতা ব্যানার্জী একটা কিছু দিলেন।”

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর এই কৌশলকে তিনি রাজনৈতিক কৌশল বলেই মনে করেন।

তবে কলকাতা শহরেরই দুই বাসিন্দা সুস্মিতা সমাদ্দার মুখার্জী ও শুভ্রা মুখার্জী, যারা ওই জগন্নাথধামের প্রসাদ পেয়েছেন বাড়িতে বসে, তারা পুরো বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে চান না।

সুস্মিতা সমাদ্দার মুখার্জীর কথায়, “জগন্নাথদেবের প্রসাদ পেয়েছি এটাই বড় কথা। তাকে আমরা পুজো করি, ভগবান বলে মানি। তাই তার প্রসাদ পেয়েছি সেই বিশ্বাস থেকেই। এর মধ্যে রাজনীতি আছে কী না, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। “

তবে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপি বলছে, যেভাবে স্থানীয়ভাবে তৈরি মিষ্টির সঙ্গে দীঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ মিশিয়ে বিলি করা হচ্ছে, তাকে আদৌ প্রসাদ বলা যায় না।

তারা এই প্রসাদের একটি বিকৃত নামও দিয়েছে, যার সঙ্গে আবার মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের খাদ্যাভ্যাস জড়িত।

বিজেপির অন্যতম রাজ্য মুখপাত্র কেয়া ঘোষ বলছিলেন, “আমি নিজে জগন্নাথ দেবের ভক্ত। বছরে অন্তত তিনবার আমি শ্রীক্ষেত্র পুরীতে যাই। কিন্তু এখানে মহাপ্রসাদ নামে তো ভাঁওতাবাজি করা হচ্ছে। কেন এই বুজরুকি?”

তবে প্রসাদ পেয়ে আপ্লুত কলকাতার বাসিন্দা শুভ্রা মুখার্জী।

“আমি এত আপ্লুত এই প্রসাদ পেয়ে যে এখানে যারা রাজনীতির রঙ চড়াচ্ছেন, মনে হয় না তারা ঠিক করছে,” বলছিলেন মিসেস মুখার্জী।

জগন্নাথের মূল ও প্রাচীন মন্দির ওড়িশার পুরীতে; সেখানকার সৈকতে বালু দিয়ে তৈরি জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি - ফাইল ছবি
জগন্নাথের মূল ও প্রাচীন মন্দির ওড়িশার পুরীতে; সেখানকার সৈকতে বালু দিয়ে তৈরি জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি – ফাইল ছবি

সাংস্কৃতিক কেন্দ্র না মন্দির?

দীঘার জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ এবং এপ্রিল মাসে সেটি উদ্বোধনের সময় থেকেই এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে।

সরকারি সংস্থা ‘হিডকো’ এই মন্দির নির্মাণ করেছে। তাই বিরোধিরা এবং অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলছেন যে সংবিধান অনুযায়ী কোনো সরকার কোনো একটি ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে না।

রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস যুক্তি দেয় যে এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, “এটাকে যদি আপনি আক্ষরিক অর্থে একটা ধর্মীয় পীঠস্থান হিসাবে দেখান, তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মুখ্যমন্ত্রী যে উদ্যোগটা নিয়েছেন, সেটা হলো ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানো। ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংস্কৃতি, পর্যটন ইত্যাদির একটা মিলনক্ষেত্র দীঘাতে উনি তৈরি করেছেন।”

“হিন্দু ধর্মের যে গোঁড়া মনোভাব আছে, সেই প্রথার বাইরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিন্দুধর্মের মূল মন্ত্র – সহনশীলতা, মুক্তচিন্তা – যে ভাবধারা কবীর, নানক বা চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবদের থেকে এসেছে, সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের কথাই ভেবেছেন মুখ্যমন্ত্রী,” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল।

বিজেপি নেত্রী কেয়া ঘোষের প্রশ্ন, “দীঘায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র যেটা উনি করেছেন, সেখানে কালচারাল সেন্টারের নাম করে উনি মন্দির বানাচ্ছেন কীসের জন্য? মন্দির নির্মাণ কি কোনো সরকারের কাজ? তারা তো স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বানাবে, চাকরি দেবে, উন্নয়ন করবে। সেটা না করে আপনার আমার করের টাকায় নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করতে নেমেছেন।”

তার কথায়, “এই পুরোটাই রাজনীতি। তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে ২০২৬ এর ভোটে শুধুই তার ভোট ব্যাংকের ভরসায় জিততে পারবেন না।”

রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলমানদের অধিকাংশই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক, এমনটাই মনে করে থাকেন প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকই।

বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে থাকে যে তার মুসলমান ভোট ব্যাংককে নিয়ে ‘তুষ্টিকরণের রাজনীতি করেন মমতা ব্যানার্জী’।

মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, তার বাঁয়ে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও একেবারে ডানে ইসকন কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস
মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, তার বাঁয়ে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও একেবারে ডানে ইসকন কলকাতার ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধারমন দাস

‘তুষ্টিকরণের’ অভিযোগ, ভারসাম্য রাখতেই জগন্নাথ?

দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের সময় থেকেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে এটা মমতা ব্যানার্জীর একটা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। আগামী বছর রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। তৃণমূল কংগ্রেস ইতোমধ্যে তিনবার জয়ী হয়েছে এবং চতুর্থবার সরকার গড়ার জন্য ভোটে লড়বে দলটি।

একদিকে তার সরকারের বিরুদ্ধে নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, অন্যদিকে আছে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগির অঙ্ক এবং তার বিরুদ্ধে বিজেপির তোলা ‘তুষ্টিকরণের রাজনীতি’র অভিযোগ।

তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র মনোজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, “তুষ্টিকরণের রাজনীতি কেন করবেন মমতা ব্যানার্জী? তিনি কালীঘাটের মন্দির থেকে সামান্য দূরে থাকেন – বাড়িতে কালীপুজো করেন। আবার গির্জা, জৈন মন্দির, গুরুদোয়ারা, মসজিদ সব জায়গাতেই যান তিনি। তাহলে কী করে কোনো একটি ধর্মের মানুষদের তুষ্ট করার কথা আসছে?”

“তবে এটাও তো প্রশ্ন যে স্বাধীনতার পর থেকে এতগুলো বছরে মুসলমান এবং দলিতদের কতটা উন্নয়ন করতে পেরেছে রাজনৈতিক দলগুলো? সরকারি চাকরিতে তারা কত শতাংশ? বিজেপি তো এই মানুষগুলোকে বাদ দিয়েই রাজনীতি করে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা এই শ্রেণির পাশে তো কাউকে একটা দাঁড়াতে হবে? সেজন্য মমতা ব্যানার্জী তাদের পাশে থাকেন,” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল।

পুরীর মন্দিরটি আদলেই নির্মিত হয়েছে দীঘার এই জগন্নাথ মন্দির
পুরীর মন্দিরটি আদলেই নির্মিত হয়েছে দীঘার এই জগন্নাথ মন্দির

পাঁচ শতাংশ ভোটের অঙ্ক

ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগির প্রশ্নে বিজেপি যেমন তুষ্টিকরণের রাজনীতির অভিযোগ তোলে মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে, তেমনই এটাও ঘটনা যে হিন্দু ভোটও তার দল অনেকটাই পেয়ে থাকে। আর সেই হিন্দু ভোটে গত কয়েক বছর ধরে বড়সড় ভাগ বসিয়েছে বিজেপি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন মুসলমানদের ভোট নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত তৃণমূল কংগ্রেস, তবে হিন্দু ভোটের অংশ আরও বাড়াতে চাইছে তারা। সেজন্যই হিন্দু দেবতার মন্দির নির্মাণ এবং তাকে ঘিরে একটা বড় কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রসূন আচার্য হিসাব দিচ্ছিলেন, “বর্তমানে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট মোটামুটিভাবে ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী মুসলমানরা যদি এ রাজ্যের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ হন, তার প্রায় সব ভোটই তৃণমূল কংগ্রেস পায়। বাকি হিন্দু ভোটও কিন্তু ৩৭-৩৮ শতাংশ যায় তৃণমূলের দিকেই।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য ওয়াল সংবাদ পোর্টালের কার্যকরী সম্পাদক অমল সরকার বলছিলেন, “সর্বশেষ যে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল, তার ফলাফল অনুযায়ী তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে পাঁচ শতাংশের ফারাক আছে এবং এটা হচ্ছে অ-মুসলিম ভোট। বিজেপি মুসলমানদের ভোট চায়ও না। তাই অ-মুসলিম ভোটের এই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ শতাংশের ফারাকটা কমাতে চায় বিজেপি।”

“বিজেপির একটাই অ্যাজেন্ডা এখন–– যে হিন্দু ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পায়, তা ছয়-সাত শতাংশ ছিনিয়ে আনতে পারলেই বিজেপি জয়ের দিকে অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে তারা মনে করে,” বলছিলেন মি. আচার্য।

অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জীও চান যে ওই পাঁচ শতাংশ অ-মুসলিম, মূলত হিন্দু ভোট যাতে আরও বেশি সংখ্যায় তার দিকে আসে। সেজন্যই হিন্দু ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের দিকে তিনি নজর দিয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

অমল সরকারের কথায়, “এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে ভোটের দিকে তাকিয়ে, বিজেপির সঙ্গে হিন্দু ভোট-শেয়ারের ফারাকটা আরও বাড়াতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে রাজনীতি প্রথম কিন্তু মিশিয়ে ছিলেন, অন্তত এ রাজ্যে, বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনিই প্রথম রামনবমীকে রাজনীতির কারণে ব্যবহার করেন।”

“বছর কয়েক পরে দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসও ওই রামনবমীকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিকভাবে। এখন যা দাঁড়িয়েছে, রাজ্যে রামনবমীর মিছিলের মধ্যে তৃণমূল নেতাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানের সংখ্যাই বোধহয় বেশি,” বলছিলেন মি. সরকার।

বিজেপি হিন্দুত্ববাদ নিয়ে, হিন্দু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা নিয়ে বিজেপি কখনোই লুকোছাপা করে না।

তবে ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে বামপন্থিরা বাদে অন্য যে দলই বিজেপির অনুকরণ করে হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করতে গেছে, তারা অসফলই থেকেছে।

অমল সরকারের কথায়, “২০২৬-এ কী হবে, তা বলা এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ছত্তিশগড়ের ভূপেশ বাঘেল বা মধ্যপ্রদেশের কমল নাথের মতো প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরা বিজেপির থেকেও যেন বড় হিন্দুত্ববাদী হয়ে উঠেছিলেন। রাহুল গান্ধী একটা সময়ে নানা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরতে শুরু করেছিলেন। আবার দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও দেখেছি একই পথে চলতে। এই সকলেই কিন্তু বিজেপির অনুকরণ করে হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে গিয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন।”

জগন্নাথদেব এবং তার প্রধান উৎসব রথযাত্রার আগে নানা রাজনৈতিক প্রশ্ন যখন উঠছে, বিতর্ক চলছে, তার মধ্যে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা শেয়ার করছেন:

“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব–হাসে অন্তর্যামী”

বিবিসি বাংলা