ঢাকা মহানগরীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের যাতায়াতে বাসই এখনও প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা, ভাড়ার অনিয়ম ও নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সংস্কার-উদ্যোগগুলোর গতি–অবগতি শহরবাসীর ভোগান্তি কতটা কমাতে পারবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এই প্রতিবেদন ঢাকার বাসসেবার বর্তমান চিত্র, চলমান প্রকল্প এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করে।
‘ঢাকা নগর পরিবহন’: রুট রেশনালাইজেশনের অগ্রগতি
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ ফের চালু হয়েছে গাবতলী–চাষাড়া রুটে ৩৫টি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বাস নিয়ে। মালিকপক্ষের আপত্তির কারণে সবুজ ক্লাস্টারের আটটি রুটের বদলে আপাতত একটিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এ সেবা। সংশ্লিষ্টরা জানান, কোম্পানি-ভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে চালক ও সহকারীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, যদিও শিগগিরই সব বাসকে একই ছাতার নিচে আনা যাবে—এমন নিশ্চয়তা নেই।¹
বাস্তব চিত্র: গতি কম, ভাড়া বেশি
মার্চের শেষ নাগাদ মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ধীরগতির কারণে দিনে সর্বোচ্চ ১৪টি ট্রিপ নেমে এসেছে গড়ে ৭-১০ ট্রিপে। ফলে স্টপেজে ৩০-৪০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। পাশাপাশি ২৫ টাকা ভাড়ার জায়গায় এসি বাসে ৫৫ টাকা নেওয়ায় অনেকেই সেবাটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাস-স্বল্পতা, প্রতিদ্বন্দ্বী নন-এসি বাসের দখল এবং টিকিট কাউন্টার না-থাকাকেই প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
ই-টিকিট ও ‘পিঙ্ক’ কাউন্টার বাস
যাত্রী হয়রানি ও চাঁদাবাজি কমাতে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গাজীপুর–উত্তরা–ঢাকা রুটে ২১টি কোম্পানির ৬১০টি গোলাপি রঙের (পিঙ্ক) বাসে ই-টিকিট ও নির্দিষ্ট কাউন্টার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। অনলাইনে অগ্রিম টিকিট কাটার সুবিধায় যাত্রীরা বলছেন—ভাড়া পরিশোধ ও ওঠা-নামায় শৃঙ্খলা বেড়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, পর্যায়ক্রমে অন্য রুটেও এ পদ্ধতি চালু করা হবে।
শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাস মালিক সমিতি ঘোষণা দেয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থী সকাল ৬টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সপ্তাহের সাত দিন পরিচয়পত্র দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় চলাচল করতে পারবে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর এ সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের খরচ কমালেও অনেক চালক এখনও বিধি মানছেন না—এমন অভিযোগ রয়েছে।
দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে কেবল ঢাকায় ৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৪৮২ জন। সারা দেশে বাস-জড়িত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬৯ জনের, যা বাসখাতের নিরাপত্তা সংকটকে স্পষ্ট করে তোলে।
সবুজ ভবিষ্যৎ: ৪০০ বৈদ্যুতিক বাসের পরিকল্পনা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ভাষণে অর্থ উপদেষ্টা জানান, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক গণপরিবহন গড়ে তুলতে ঢাকায় ধাপে ধাপে ৪০০ বৈদ্যুতিক বাস চালু করা হবে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দূষণ ও জ্বালানি ব্যয় কমার পাশাপাশি যাত্রীসেবাও উন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
- ব্যবস্থাপনার সমন্বয়: ডিটিসিএ, দুই সিটি করপোরেশন ও পুলিশ-সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় জোরদার করে নন-এসি ও বেসরকারি বাসগুলোকে পর্যায়ক্রমে একীভূত করতে হবে।
- ভাড়া নীতি ও মনিটরিং: ডিজিটাল টিকিট নিশ্চিত করে সাধারণ ও অর্ধেক ভাড়া নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
- নিরাপত্তা সংস্কার: চালক-সহকারী প্রশিক্ষণ, ব্রেক-পরীক্ষা, নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা এবং সড়ক পরিবহন আইনের কঠোর প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
- ই-টিকিট ও র্যাপিড পাস সম্প্রসারণ: একটি কার্ডে মেট্রো, বাস ও লঞ্চ—একত্রিত পেমেন্ট পদ্ধতি চালু করা গেলে যাত্রীরা আরও সহজে সেবা পাবেন।
- পরিবেশবান্ধব যানবাহন: ই-বাস ছাড়াও কম দূষণকারী সিএনজি ও হাইব্রিড বাসের বহর বাড়ানো প্রয়োজন।
পরিকল্পনার ঘাটতি নেই—সমস্যা বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতায়। রুট রেশনালাইজেশন, ই-টিকিট, অর্ধেক ভাড়া ও বৈদ্যুতিক বাস—সব উদ্যোগই যাত্রীবান্ধব ও টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মালিক-শ্রমিক ঐক্য এবং কঠোর তদারকির মাধ্যমেই রাজধানীর বাসসেবাকে শৃঙ্খলিত ও আধুনিক করা সম্ভব।