মাসের শুরুতে ইরানি আকাশে যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান আর মার্কিন বোমারু উড়ে গেল, তখন মধ্যপ্রাচ্যের পুরোনো এক কৌশলই যেন পুনরায় মঞ্চস্থ হলো—গোপন বৈঠক, ঢেকে রাখা উদ্দেশ্য আর আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের নির্মম তাগিদ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ অঞ্চলকে তাড়া করে ফিরছে।
এই প্রক্রিয়ার সূচনা আরও কয়েক দশক আগে, ইরাকে মার্কিন বিমান হামলার ধোঁয়ার ভেতর, আর ওয়াশিংটনের সেই স্থির হিসাব-নিকাশ থেকে—যেভাবেই হোক, ইসরায়েলকে সামরিক মানে অপরাজেয় অবস্থানে রাখা চাই।
১৯৯০-এর শেষ দিকে, মার্কিন ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান—উভয় দলের কয়েক সিনেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতে পা রাখেন। সে সময় চলছিল যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ইরাকবিষয়ক হামলার ধারাবাহিকতা, যা উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতে অস্ত্র স্তব্ধ হওয়ার পরও পুরো অঞ্চলে স্থায়ী অস্বস্তি বয়ে বেড়াচ্ছিল।
এক উচ্চপদস্থ আমিরাতি কর্মকর্তা তখন বিরক্ত কণ্ঠে সেই প্রশ্নটি তুলেছিলেন, যেটি তখন উপসাগরীয় শক্তিমহলের অলিন্দে নীরবে ফিসফিসে হচ্ছিল—ওয়াশিংটন কেন সাদ্দামকে সরিয়েই দেয় না?
সিনেটরটির উত্তরে লুকোচুরি ছিল না। তাঁর ভাষায়, উদ্দেশ্য সিংহাসন বদল নয়, বরং “ইসরায়েলের মতো সামরিক ও প্রযুক্তিগত স্তরে থাকা কোনো আঞ্চলিক রাষ্ট্রকে প্রাক-শিল্প যুগে ঠেলে দেওয়া।” এ কথোপকথন পরে ওই কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে শোনান।
৯/১১–এর পর নীতিতে পরিণত সেই ধারণা
একদা কট্টর নব্যরক্ষণশীল চিন্তাবিদদের আলাপচারিতায় সীমিত থাকা এজেন্ডাই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর দ্রুত সরকারি নীতিতে রূপ নেয়। পেন্টাগনের নথিপত্রে তখন আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাঁচটি দেশে যুদ্ধ ও শাসন-পরিবর্তনের নকশা আঁকা হয়।
আফগানিস্তান ছিল প্রথম লক্ষ্যবস্তু। এর পর ২০০৩-এ মিথ্যা অভিযোগে—যেন সাদ্দামের হাতে গণবিনাশী অস্ত্র আছে—ইরাক দখল করে আমেরিকা, যদিও সে সব অস্ত্র আগেই জাতিসংঘ পরিদর্শকদের নজরদারিতে ধ্বংস হয়েছিল।
ইউএই-তে ইঙ্গিতিত যে নকশা, তা দুঃখজনক নিয়মমাফিকই এগোতে থাকে—লিবিয়া, সিরিয়া এবং সবশেষে ইরান সেই ভাঁজে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য আমূল বদলে দেয়।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি অভিযানে সেই ছায়া
এ চিত্রেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল ১৩ জুন থেকে বারো দিনের ইসরায়েলি আকাশ আক্রমণে—তেহরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামকে বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়াই নাকি লক্ষ্য। কিন্তু বোমা পড়তেই যুক্তি বদলায়: এখন আলোচনার কেন্দ্রে শাসন-পরিবর্তন, এমনকি ইরানি রাষ্ট্র ভেঙে ফেলার কথাও উঠে আসে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো অস্বীকার, কখনো আবার প্রকাশ্যে এসব আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতায় তাই সংশয় ঘনীভূত।
ট্রাম্প গোয়েন্দা তথ্য উপেক্ষা করে দাবি করেন, মার্কিন বি-টু স্টেলথ বোমারু “ইরানের সবচেয়ে বড় তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস” করেছে। তাঁর টুইট ঘোষণায় যুদ্ধবিরতির খবর ছড়াতেই নেতানিয়াহু বিজয়ের দাবি করেন, “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নর্দমায় গেছে।” পরদিন অবশ্য ইসরায়েলি সেনা মুখপাত্র বলেন, প্রকৃত ক্ষতি জানতে “এখনও সময় লাগবে।”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি পরে স্বীকার করেন, “ক্ষয়ক্ষতি কম নয়, আমাদের স্থাপনায় গুরুতর ক্ষতি হয়েছে।”
‘পারমাণবিক’ দ্বিধা ও সম্ভাব্য পথ
রাজনৈতিক সমাধানের একটা আশা এখনো টিকে আছে—ইরান যদি সম্পূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ থামিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে পশ্চিমা শক্তি। কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষক বিল পার্কের মতে, ইরান হয় গোপনে যে ইউরেনিয়াম বেঁচে আছে, তা সামরিকীকরণের দিকে যেতে পারে—নিজেকে বাঁচাতে এটাই হয়তো শেষ আশ্রয়, নইলে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা অনুধাবন করে পুরো কর্মসূচিই ত্যাগ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক গাই বার্টন মনে করেন, সাম্প্রতিক হামলার পর “নজিরবিহীন স্পষ্টতা” এসে গেছে—ইরান আর ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ ধরে রাখতে পারবে না। তাঁর ভাষায়, ওয়াশিংটনের ভূমিকা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র আদতে “শুভ ইচ্ছায়” কাজ করেনি।
এ অবস্থায় ইরান উত্তর কোরিয়ার মডেল অনুসরণ করে দ্রুত পারমাণবিক বোমার পথে হাঁটতে পারে, যাতে আরেক দফা আক্রমণ এড়ানো যায়—ফলে আঞ্চলিক নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় শেষ পেরেক ঠুকে যেতে পারে। তবে তা মসাদের নজরে পড়বে, আগামি হামলার ঝুঁকিও বাড়াবে।
অন্যদিকে, ইরান তার ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ অবশিষ্ট জোটসঙ্গীদের হাত ধরে অঞ্চল অস্থিতিশীল করতে পারে, কিংবা সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর কড়া খেসারত দেখে আরেক দফা হস্তক্ষেপের লাভ-ক্ষতি ভেবেও দেখতে পারে।
কে লাভবান, কে ক্ষতিগ্রস্ত?
আরব উপসাগর ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ হুসেইন ইবিশ বুঝিয়ে বলেন, বড় শক্তিগুলো এখন স্থিতি চায়, কিন্তু ইয়েমেনের হুথি মত ছোট গোষ্ঠীগুলো বিশৃঙ্খলাই কামনা করে। সবচেয়ে নাজুক—সিরিয়া, লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেন—যেগুলোর “সর্বস্ব ভোগদখলে নিয়েছে ইরান ও তার অনুচররা।”
চ্যাথাম হাউসের বিশ্লেষক আহমেদ আবুদুহের মতে, ২০২৩-এর গাজা যুদ্ধের পর থেকেই পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোট ইরানকে দুর্বল ও একঘরে করতে নতুন শক্তির মানচিত্র আঁকছে। নেতানিয়াহু এ সুযোগে “ইসরায়েলকে অঞ্চলজুড়ে শীর্ষক্ষমতায় তুলতে চেয়েছেন।”
এদিকে যুদ্ধ চীনের সীমিত প্রভাবও উন্মোচিত করেছে—বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রক্ষায় বেইজিং নিরুপায় ছিল। ফলে বিকল্প মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভাবমূর্তিও ঝাপসা হয়েছে—যখনই যুদ্ধ থামাতে হয়, শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্রই নেমে আসে।
গত দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিসংযোজন নাটকীয়ভাবে বদলেছে, ইরানের পতনই যার প্রধান চালিকাশক্তি। সিরিয়ার পতনের পর ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব প্রায় শেষ। একমাত্র রাষ্ট্রীয় মিত্র ছিল সিরিয়া; তার বাইরে শুধু মিলিশিয়া আর বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী। এখন ইসরায়েলের নবউদ্ধত আচরণ অনেকের চোখে একে “সর্বাধিক আগ্রাসী ও বিপজ্জনক” খেলোয়াড় বানিয়েছে।
গালফ রাজতন্ত্রগুলো প্রকাশ্যে সংযম দেখালেও আসলে যুক্তরাষ্ট্রকেই নিরাপত্তার প্রধান ভরসা হিসেবে রাখার পক্ষে। ভবিষ্যতের প্রভাব নির্ভর করবে অর্থনৈতিক শক্তির উপর—বিশেষত সৌদি আরব, কাতার, ইউএই-এর তেলসম্পদ তাদের সামরিক সামর্থ্যের চেয়ে বহুগুণ প্রভাব কিনে দেয়।
ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে আলাদা থাকলেও ইরানের দুর্বলতার ফায়দা তুলতে পারে; তুরস্কও, ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহৎ সেনাবাহিনী নিয়ে, আপাত শক্তিশালী। তবে সামগ্রিক হিসাবে আঙ্কারাও খুব বেশি ঝুঁকি নেবে না।
আসল ফাটল: ফিলিস্তিন প্রশ্ন
বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দেন, ২০২৩-এর অক্টোবরের পরও মধ্যপ্রাচ্যের মূল বিভাজন অপরিবর্তিত—ফিলিস্তিন সংকট। গাজা ও পশ্চিম তীর দখল যদি ইসরায়েল এগিয়ে নেয়, তা “দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়” ডেকে আনবে। জর্ডান নিশ্চিতভাবেই সম্পর্ক ছিন্ন করবে, মিসরও পারে; ইউএই বিকল্প পন্থা খুঁজবে, বাহরাইন চুপ করে থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন, ঐক্যবদ্ধ আরব ফ্রন্ট গঠনের চাপ “প্রবল, যদি না অনিবার্য” হয়ে উঠতে পারে।