বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতি দুই জন গর্ভবতী নারীর একজনেরও বেশি আয়রন ঘাটতি–জনিত অ্যানিমিয়ায় (রক্তস্বল্পতা) ভুগছেন—যা মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর তীব্র ঝুঁকি তৈরি করছে। সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণা ও সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পরিসংখ্যানে কী দেখা যাচ্ছে
- ২০২৪-এর দক্ষিণাঞ্চলকেন্দ্রিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,গ্রামীণ গর্ভবতী নারীদের ৫০ শতাংশ অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত; এর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশের অবস্থা মাঝারি থেকে গুরুতর।
• বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে গর্ভাবস্থায় আয়রন ঘাটতির হার ৪৬ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
• আরেকটি গ্রামীণ জরিপে ১৫০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে ৩৮ শতাংশের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের নিচে এবং ৪৮ শতাংশের সেরাম ফেরিটিন-নির্ভর আয়রন ঘাটতি পাওয়া গেছে।
আয়রন ঘাটতির মূল কারণ
খাদ্য বৈচিত্র্যের অভাব: দরিদ্র পরিবারগুলোতে মাংস, ডিম ও ডালজাতীয় আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত থাকে না।
নিয়মিত প্রসূতি সেবা (ANC) না নেওয়া: চারবারের কম এএনসি ও আয়রন-ফোলিক অ্যাসিড (আইএফএ) ট্যাবলেট অনিয়মিত সেবন অ্যানিমিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
অপরিচ্ছন্ন পানি-স্যানিটেশন ও কৃমি সংক্রমণ: কৃমির আক্রমণ শরীরে রক্তক্ষয় বাড়িয়ে দিয়ে আয়রন ঘাটতিকে তীব্র করে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা বড়?
আয়রন ঘাটতি-সংক্রান্ত অ্যানিমিয়া মাতৃমৃত্যু, দীর্ঘমেয়াদি প্রসব, অপরিণত জন্ম (প্রি-টার্ম), কম ওজনের নবজাতক ও শিশুর রক্তস্বল্পতা বাড়ায়। এ ছাড়া শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশও ব্যাহত হতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ ও মাঠের বাস্তবতা
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিদিন ৬০ মি. গ্রা. আয়রন ও ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফোলিক অ্যাসিড সেবনের নির্দেশনা দিয়েছে। আইএফএ ট্যাবলেট বিনা মূল্যে বিতরণ করা হলেও সরবরাহ-ঘাটতি, তদারকির দুর্বলতা এবং ট্যাবলেট খেতে অনীহা—সব মিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা সৃষ্টি করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
- শুধু ট্যাবলেট নয়,আয়রন-সমৃদ্ধ খাদ্য (ডাল, শাক-সবজি, ছোট মাছ, ডিম) নিশ্চিত করতে হবে।
• হাত ধোয়া ও কৃমিনাশক কর্মসূচি একসঙ্গে জোরদার করা জরুরি। - • ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রাকৃতিক আয়রনের মাত্রা কম এমন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ইন্ট্রাভেনাস (IV) আয়রন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে বলেছেন পুষ্টি-গবেষকেরা।
সুপারিশ ও করণীয়
আইএফএ ট্যাবলেটের সরবরাহ ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো—স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত বাজেট ও নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্য-ভিত্তিক সমাধান—কমিউনিটি “পুষ্টি রান্না ক্লাসে” সাশ্রয়ী কিন্তু আয়রন-সমৃদ্ধ রেসিপি ছড়িয়ে দেওয়া।
স্কুল ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা—কিশোরী বয়স থেকেই আয়রন-ফোলিক অ্যাসিড পরিপূরক এবং পুষ্টি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
গবেষণা ও নজরদারি—ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো চিহ্নিত করে নিয়মিত হিমোগ্লোবিন ও সেরাম ফেরিটিন পরীক্ষা করা।
সরকারি নীতিমালা মাঠপর্যায়ে কার্যকর নজরদারি ও সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীদের আয়রন ঘাটতি-জনিত ঝুঁকি দ্রুত কমানো সম্ভব—এমনটাই আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।