০৬:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

শতবর্ষের ইতিহাস বয়ে চলা গোমতী নদী: সভ্যতা, বাণিজ্য আর জীববৈচিত্র্যের উপাখ্যান

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বয়ে যাওয়া গোমতী নদী এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বহমান ইতিহাসের সাক্ষী। ত্রিপুরা থেকে জন্ম নিয়ে কুমিল্লা হয়ে মেঘনা নদীতে মিশে যাওয়া এই নদীর গল্প শুধু পানি নয়—জড়িয়ে আছে মানুষের সভ্যতা, নদীপারের বনভূমি, বন্যপ্রাণী, জলজসম্পদ আর বাণিজ্যিক যোগাযোগের এক বিস্তৃত ইতিহাস।

নদীর উৎপত্তি ও গতিপথ

গোমতীর উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উঁচু টিলা এলাকা। সেখান থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ স্রোত বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার সীমান্তে প্রবেশ করে, নানা বাঁক, খাত, চর আর গ্রাম পেরিয়ে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। এক শতাব্দী আগে এর গতিপথ ছিল আরও প্রাকৃতিক, অবারিত আর সজীব। নদীর বুকের বালুচর, পাড়ের কাদামাটি ছিল কৃষিজমির জন্য অত্যন্ত উর্বর।

শতবর্ষের সভ্যতা ও গ্রামীণ জীবন

গোমতী নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ। শত বছর আগে এই নদী ছিল কুমিল্লা শহরের প্রাণ। নদীপথেই পণ্য আসত কুমিল্লা বাজারে। নৌকা, ডিঙি, পালতোলা সাম্পান—এসবই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। কৃষকরা তাদের ধান, পাট, তিল, আখ, মাছ আর মাটি দিয়ে বানানো পণ্য এই নদীপথে বাজারে আনতেন।

নদীপাড়ের জনপদগুলোতে হাটবাজারের বিকাশও ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীর পানিই ছিল সেচের বড় উৎস। শত বছর আগের কৃষিনির্ভর জীবনে গোমতীর গুরুত্ব অপরিসীম ছিল।

নদীর দুই পারে বনভূমি

এক শতাব্দী আগের গোমতীর দুই পাড়ে ছায়াঘন বনভূমি দেখা যেত। বাঁশঝাড়, বেল,কদম, শিমুল, অশ্বত্থ, হিজল, করচ, বরুণ—বহু প্রজাতির গাছ নদীর তীরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত। বর্ষায় নদী ফুলে ফেঁপে উঠে এসব বনের মাটি পলিমাটি দিয়ে সমৃদ্ধ করত।

এই বনের কাঠ, পাতা, ফল গ্রামের মানুষের জীবিকার অংশ ছিল। কাঠ জ্বালানি, ঘর তৈরির উপকরণ, নৌকা বানানোর কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছ শুকানোর বাঁশের চাতাল তৈরি হতো নদীপারের বাঁশ দিয়ে।

নদীর তীরের বন্যপ্রাণী

গোমতীর পাড়ের বনভূমি ছিল নানা বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল। শত বছর আগেও এখানে খরগোশ, মেছোবাঘ, শিয়াল, বন্য ছাগল, সাপ, নানাধরনের পাখি দেখা যেত। বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখিরা ভিড় করত নদীর চরে। বক, জলমুরগি, শামুকখোল, ঘুঘু, টিয়া, বুলবুলি নদীর পাড়ের বনে ডেকে উঠত।

নদীর চর ও বনে স্থানীয় মানুষরা শিকার করত জীবিকা ও খাবারের জন্য। তবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য একসময় ঠিক ছিল; বনভূমি ও জীবজগত নদীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেছিল।

গোমতীর জলে মাছের রাজত্ব

একশ বছর আগে গোমতী ছিল মাছের রাজ্য। রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, শোল, গজার, কৈ, টেংরা, পুঁটি, শিং, মাগুরের মত দেশি মাছ নদীতে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্ষায় নদীর বন্যায় মাঠে পানি ঢুকে মাছের প্রজনন হতো। নদীর জোয়ারভাটার ছন্দে মাছেরা চলাচল করত।

মাছ ধরাই ছিল হাজারো মানুষের জীবিকা। বড়শি, জাল, বেহুন্দি, চাপার জাল, কোষা জাল—নানা কৌশলে মাছ ধরা হতো। মাছ কুমিল্লার বাজারে যেত নদীপথেই।

নদীর বাণিজ্য ও যোগাযোগ

এক শতাব্দী ধরে গোমতী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বাণিজ্যিক শিরা। ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে লবণ, কাঁচা চামড়া, কাঠ, শস্য আসত কুমিল্লা হয়ে ঢাকার বাজারে। নদীই ছিল সহজতম, সস্তা আর কার্যকর পথ। অনেক বড় নৌকাও চলত গোমতীর উপর দিয়ে।

এ নদীপথে ঢাকাগামী নৌকা মালপত্র বহন করত, আবার কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরায় রফতানি হতো ধান, পাট, মসলিন কাপড়ের কাঁচামাল। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লা শহরের নদীবন্দর, ঘাট আর ব্যবসায়ী পাড়া।

নদীর পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ

এক শতাব্দীর মধ্যে গোমতী অনেক বদলে গেছে। নদীর গভীরতা কমেছে, পলিমাটি ভরেছে, প্রবাহ দুর্বল হয়েছে। নদীর পাড়ের বনভূমি উজাড় হয়েছে। বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে। জলজপ্রাণীর বৈচিত্র্য কমে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে হাঁটু পানি থাকে।

নদীর বুক দখল, অপরিকল্পিত সেতু, বাঁধ আর দূষণ গোমতীর প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। এক সময়ের ব্যস্ত নৌপথ এখন প্রায় বিলুপ্ত।

গোমতী নদীর একশ বছরের ইতিহাস আমাদের শিখিয়ে দেয় নদীর সাথে মানুষের বেঁচে থাকা কতটা অঙ্গাঙ্গি। সভ্যতা, বাণিজ্য, বনভূমি, প্রাণীকুল, মাছের ভান্ডার—সবই নদীর দান। গোমতীর মত নদীগুলোকে রক্ষা করা মানে শুধু পানি নয়, পুরো এক ঐতিহ্য আর জীবনের ধারাকে রক্ষা করা।

আজ প্রয়োজন নতুন করে নদীর পুনর্জীবন পরিকল্পনা, যাতে আবার জেগে ওঠে গোমতীর প্রাণ, আর নদীর স্রোতে গড়ে ওঠে মানুষের টেকসই উন্নয়ন।

জনপ্রিয় সংবাদ

শতবর্ষের ইতিহাস বয়ে চলা গোমতী নদী: সভ্যতা, বাণিজ্য আর জীববৈচিত্র্যের উপাখ্যান

০৪:৫৬:০৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বয়ে যাওয়া গোমতী নদী এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বহমান ইতিহাসের সাক্ষী। ত্রিপুরা থেকে জন্ম নিয়ে কুমিল্লা হয়ে মেঘনা নদীতে মিশে যাওয়া এই নদীর গল্প শুধু পানি নয়—জড়িয়ে আছে মানুষের সভ্যতা, নদীপারের বনভূমি, বন্যপ্রাণী, জলজসম্পদ আর বাণিজ্যিক যোগাযোগের এক বিস্তৃত ইতিহাস।

নদীর উৎপত্তি ও গতিপথ

গোমতীর উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উঁচু টিলা এলাকা। সেখান থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ স্রোত বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার সীমান্তে প্রবেশ করে, নানা বাঁক, খাত, চর আর গ্রাম পেরিয়ে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। এক শতাব্দী আগে এর গতিপথ ছিল আরও প্রাকৃতিক, অবারিত আর সজীব। নদীর বুকের বালুচর, পাড়ের কাদামাটি ছিল কৃষিজমির জন্য অত্যন্ত উর্বর।

শতবর্ষের সভ্যতা ও গ্রামীণ জীবন

গোমতী নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ। শত বছর আগে এই নদী ছিল কুমিল্লা শহরের প্রাণ। নদীপথেই পণ্য আসত কুমিল্লা বাজারে। নৌকা, ডিঙি, পালতোলা সাম্পান—এসবই ছিল মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। কৃষকরা তাদের ধান, পাট, তিল, আখ, মাছ আর মাটি দিয়ে বানানো পণ্য এই নদীপথে বাজারে আনতেন।

নদীপাড়ের জনপদগুলোতে হাটবাজারের বিকাশও ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীর পানিই ছিল সেচের বড় উৎস। শত বছর আগের কৃষিনির্ভর জীবনে গোমতীর গুরুত্ব অপরিসীম ছিল।

নদীর দুই পারে বনভূমি

এক শতাব্দী আগের গোমতীর দুই পাড়ে ছায়াঘন বনভূমি দেখা যেত। বাঁশঝাড়, বেল,কদম, শিমুল, অশ্বত্থ, হিজল, করচ, বরুণ—বহু প্রজাতির গাছ নদীর তীরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত। বর্ষায় নদী ফুলে ফেঁপে উঠে এসব বনের মাটি পলিমাটি দিয়ে সমৃদ্ধ করত।

এই বনের কাঠ, পাতা, ফল গ্রামের মানুষের জীবিকার অংশ ছিল। কাঠ জ্বালানি, ঘর তৈরির উপকরণ, নৌকা বানানোর কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছ শুকানোর বাঁশের চাতাল তৈরি হতো নদীপারের বাঁশ দিয়ে।

নদীর তীরের বন্যপ্রাণী

গোমতীর পাড়ের বনভূমি ছিল নানা বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল। শত বছর আগেও এখানে খরগোশ, মেছোবাঘ, শিয়াল, বন্য ছাগল, সাপ, নানাধরনের পাখি দেখা যেত। বিশেষ করে শীতকালে অতিথি পাখিরা ভিড় করত নদীর চরে। বক, জলমুরগি, শামুকখোল, ঘুঘু, টিয়া, বুলবুলি নদীর পাড়ের বনে ডেকে উঠত।

নদীর চর ও বনে স্থানীয় মানুষরা শিকার করত জীবিকা ও খাবারের জন্য। তবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য একসময় ঠিক ছিল; বনভূমি ও জীবজগত নদীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেছিল।

গোমতীর জলে মাছের রাজত্ব

একশ বছর আগে গোমতী ছিল মাছের রাজ্য। রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, শোল, গজার, কৈ, টেংরা, পুঁটি, শিং, মাগুরের মত দেশি মাছ নদীতে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্ষায় নদীর বন্যায় মাঠে পানি ঢুকে মাছের প্রজনন হতো। নদীর জোয়ারভাটার ছন্দে মাছেরা চলাচল করত।

মাছ ধরাই ছিল হাজারো মানুষের জীবিকা। বড়শি, জাল, বেহুন্দি, চাপার জাল, কোষা জাল—নানা কৌশলে মাছ ধরা হতো। মাছ কুমিল্লার বাজারে যেত নদীপথেই।

নদীর বাণিজ্য ও যোগাযোগ

এক শতাব্দী ধরে গোমতী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বাণিজ্যিক শিরা। ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে লবণ, কাঁচা চামড়া, কাঠ, শস্য আসত কুমিল্লা হয়ে ঢাকার বাজারে। নদীই ছিল সহজতম, সস্তা আর কার্যকর পথ। অনেক বড় নৌকাও চলত গোমতীর উপর দিয়ে।

এ নদীপথে ঢাকাগামী নৌকা মালপত্র বহন করত, আবার কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরায় রফতানি হতো ধান, পাট, মসলিন কাপড়ের কাঁচামাল। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লা শহরের নদীবন্দর, ঘাট আর ব্যবসায়ী পাড়া।

নদীর পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ

এক শতাব্দীর মধ্যে গোমতী অনেক বদলে গেছে। নদীর গভীরতা কমেছে, পলিমাটি ভরেছে, প্রবাহ দুর্বল হয়েছে। নদীর পাড়ের বনভূমি উজাড় হয়েছে। বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে। জলজপ্রাণীর বৈচিত্র্য কমে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে হাঁটু পানি থাকে।

নদীর বুক দখল, অপরিকল্পিত সেতু, বাঁধ আর দূষণ গোমতীর প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। এক সময়ের ব্যস্ত নৌপথ এখন প্রায় বিলুপ্ত।

গোমতী নদীর একশ বছরের ইতিহাস আমাদের শিখিয়ে দেয় নদীর সাথে মানুষের বেঁচে থাকা কতটা অঙ্গাঙ্গি। সভ্যতা, বাণিজ্য, বনভূমি, প্রাণীকুল, মাছের ভান্ডার—সবই নদীর দান। গোমতীর মত নদীগুলোকে রক্ষা করা মানে শুধু পানি নয়, পুরো এক ঐতিহ্য আর জীবনের ধারাকে রক্ষা করা।

আজ প্রয়োজন নতুন করে নদীর পুনর্জীবন পরিকল্পনা, যাতে আবার জেগে ওঠে গোমতীর প্রাণ, আর নদীর স্রোতে গড়ে ওঠে মানুষের টেকসই উন্নয়ন।