০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

আগুনের ছাই কারখানা—এক গার্মেন্ট শ্রমিক নারীর লড়াই

সারাংশ

  • গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুনে পুরো ইউনিট পুড়ে যায়, এতে ৪৫০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন
  • আয় অনেক কমে গেছে, অথচ চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ
  • সরকারি বা এনজিও সহায়তা পাননি সালমা। তবুও হাল ছাড়েননি। ভবিষ্যতে আবার কারখানায় কাজ করার স্বপ্ন দেখেন

ঢাকার অদূরে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাত সাড়ে দশটায় ভয়াবহ আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সেই আগুনে পুড়ে যায় পুরো ইউনিট—মেশিন, মজুত মাল, ভবন সবই। মালিকপক্ষ দ্রুত ঘোষণা দেয় কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। মুহূর্তেই ৪৫০ জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন; তাঁদেরই একজন ৩৪ বছর বয়সী সালমা খাতুন।

দুই সন্তান আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে গাজীপুরের একটি টিনের ঘরে থাকেন সালমা। আগুনের পর থেকে তাঁর আর কোনও চাকরি নেই। অথচ চাল-ডাল-তেল-সবজির দাম আকাশছোঁয়া। আজও থামেনি তাঁর লড়াই—একসময়ের গার্মেন্টের লাইন ইনচার্জ সালমা এখন অন্যের বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে কোনোরকমে পরিবারের খাবার জোগাচ্ছেন।

আগুনের রাত ও চাকরি হারানো

সালমার কথায়,

“রাত ১১টার পরে ফোন পেলাম—কারখানায় আগুন। ভোরে গিয়ে দেখি সব ছাই। মালিক বলল, আর কাজ নেই, কিছু টাকা দিল না। আমরা তো আর কিছু জানতামও না—সেই কারখানাতেই ৯ বছর কাজ করছিলাম।”

পরবর্তীতে মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলেও তালিকায় সালমার নাম ওঠেনি। তাঁরই ভাষায়,

“কারখানা পুড়ল, আমাদের জীবনও পুড়ল।”

উচ্চমূল্যের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সংগ্রাম

আগুনের কয়েক মাস পরই শুরু হয় দামের ঝাঁজ। তেল, চাল, ডাল, সবজি, আলু—সব কিছুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।

“আগে যে চাল ৫০ টাকায় নিতাম, এখন ৭৫-৮০। ডাল ১১০ টাকা কেজি। ৫০০ টাকায় বাজার করতাম, এখন হাজার টাকায়ও হয় না,”—জানালেন সালমা।

একসময় মাসিক আয় ছিল ১২ হাজার টাকা; চাকরি হারিয়ে সেটি নেমে আসে শূন্যে। এখন গৃহকর্মীর কাজ করে মাসে মোটে ৩-৪ হাজার টাকা রোজগার করেন।

“চার দিন কাজ থাকলে তিন দিন থাকে না। যা পাই, বাজারের দাম দেখে কাঁদি।”

খাদ্যের পরিমাণ কমানোমানের ছাড়

উচ্চমূল্যের বাজারে চলতে গিয়ে কীভাবে খরচ ম্যানেজ করছেন? সালমার উত্তর—

“আগে দিনে দুইবার মাংস বা ডিম হতো। এখন ডিমও সপ্তাহে একবার। তরকারি কমিয়ে পানি বাড়াই। ছেলেপুলে আগে ভাত খেত দুই বেলা, এখন এক বেলা।”

অভাবের চাপে বাচ্চাদের স্কুল থেকেও বের করে দিতে হয়েছে।

“খরচ সামলানো যাচ্ছে না। ছেলে বলল, আমিও কাজ করব।”

ধার-দেনা আর মহাজনের কিস্তি

আগুনের পর থেকে কয়েক মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়ে আছে।

“মালিক বলেছিল, ‘বোন, দুই মাস মাফ।’ কিন্তু পরে আবার চাপ,”—বললেন সালমা।

স্থানীয় মহাজন থেকে ৫ হাজার টাকা সুদে ধার নিয়েছিলেন, যা সুদে-আসলে এখন ৭ হাজারে পৌঁছেছে।

“মাসে ৫০০ করে শোধ দিই—না পারলে গালাগাল শুনতে হয়।”

পরিবারের মানসিক চাপ

স্বামী আগে রিকশা চালাতেন; এখন ডায়াবেটিসে ভুগে দুর্বল, কাজ করতে পারেন না। সালমা বলেন,

“কাজ নেই, টাকা নেই, খাবার নেই—রাতে স্বামী বলে, ‘মরে যাই।’ আমি বাচ্চাদের জড়িয়ে কাঁদি।”

সহায়তা কেন নেই?

সরকারি ত্রাণ বা সহায়তা পেয়েছেন কি?

“ইউনিয়ন অফিসে গিয়েছিলাম। বলল, নাম নেই। বললাম, নাম ঢোকান—কেউ শুনল না।”

কোনো এনজিওর সহায়তাও মেলেনি।

“একবার এক মেয়ে ৫ কেজি চাল দিল। এরপর আর কেউ আসেনি।”

. স্বপ্নআশা আর বাস্তবতা

এই কারখানাতেই তিনি লাইন ইনচার্জ ছিলেন; নতুন শ্রমিকদের কাজ শেখাতেন।

“কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছি নিজের হাতে বেতন জমিয়ে। এখন নিজের বাচ্চার স্কুলের খরচও দিতে পারি না।”

তবু হাল ছাড়েননি,

“আশা করি আবার কোনো কারখানা খুলবে, আবার কাজ করব। তবে বয়স তো বেড়েছে—নেবে কিনা জানি না।”

সমাজের চোখে

পাড়া-প্রতিবেশীরা সহানুভূতি দেখালেও ধার দিতে রাজি নয়।

“সবাই তো কষ্টে। কারও কাছে চাইলে দেয় না—কারও ঘরে চাল নেই, কীভাবে দেবে?”

 এই শহরে সালমার মতো হাজার হাজার শ্রমিক আছেন। একটি আগুন কেবল কারখানাই নয়, পুড়িয়ে দেয় তাদের স্বপ্নও। বাজারের অগ্নিমূল্যে টিকে থাকতে গিয়ে তাঁরা কম খেয়ে, ধার করে, সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে—যেভাবেই হোক বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। এসব না-শোনা গল্পই আসলে আমাদের শ্রমনির্ভর অর্থনীতির বাস্তব চিত্র—যেখানে একটি দুর্ঘটনা মানেই পুরো একটি পরিবারের জীবন থমকে যাওয়া।

জনপ্রিয় সংবাদ

আগুনের ছাই কারখানা—এক গার্মেন্ট শ্রমিক নারীর লড়াই

০৪:০০:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫

সারাংশ

  • গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুনে পুরো ইউনিট পুড়ে যায়, এতে ৪৫০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন
  • আয় অনেক কমে গেছে, অথচ চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ
  • সরকারি বা এনজিও সহায়তা পাননি সালমা। তবুও হাল ছাড়েননি। ভবিষ্যতে আবার কারখানায় কাজ করার স্বপ্ন দেখেন

ঢাকার অদূরে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাত সাড়ে দশটায় ভয়াবহ আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। সেই আগুনে পুড়ে যায় পুরো ইউনিট—মেশিন, মজুত মাল, ভবন সবই। মালিকপক্ষ দ্রুত ঘোষণা দেয় কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। মুহূর্তেই ৪৫০ জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন; তাঁদেরই একজন ৩৪ বছর বয়সী সালমা খাতুন।

দুই সন্তান আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে গাজীপুরের একটি টিনের ঘরে থাকেন সালমা। আগুনের পর থেকে তাঁর আর কোনও চাকরি নেই। অথচ চাল-ডাল-তেল-সবজির দাম আকাশছোঁয়া। আজও থামেনি তাঁর লড়াই—একসময়ের গার্মেন্টের লাইন ইনচার্জ সালমা এখন অন্যের বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে কোনোরকমে পরিবারের খাবার জোগাচ্ছেন।

আগুনের রাত ও চাকরি হারানো

সালমার কথায়,

“রাত ১১টার পরে ফোন পেলাম—কারখানায় আগুন। ভোরে গিয়ে দেখি সব ছাই। মালিক বলল, আর কাজ নেই, কিছু টাকা দিল না। আমরা তো আর কিছু জানতামও না—সেই কারখানাতেই ৯ বছর কাজ করছিলাম।”

পরবর্তীতে মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলেও তালিকায় সালমার নাম ওঠেনি। তাঁরই ভাষায়,

“কারখানা পুড়ল, আমাদের জীবনও পুড়ল।”

উচ্চমূল্যের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সংগ্রাম

আগুনের কয়েক মাস পরই শুরু হয় দামের ঝাঁজ। তেল, চাল, ডাল, সবজি, আলু—সব কিছুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।

“আগে যে চাল ৫০ টাকায় নিতাম, এখন ৭৫-৮০। ডাল ১১০ টাকা কেজি। ৫০০ টাকায় বাজার করতাম, এখন হাজার টাকায়ও হয় না,”—জানালেন সালমা।

একসময় মাসিক আয় ছিল ১২ হাজার টাকা; চাকরি হারিয়ে সেটি নেমে আসে শূন্যে। এখন গৃহকর্মীর কাজ করে মাসে মোটে ৩-৪ হাজার টাকা রোজগার করেন।

“চার দিন কাজ থাকলে তিন দিন থাকে না। যা পাই, বাজারের দাম দেখে কাঁদি।”

খাদ্যের পরিমাণ কমানোমানের ছাড়

উচ্চমূল্যের বাজারে চলতে গিয়ে কীভাবে খরচ ম্যানেজ করছেন? সালমার উত্তর—

“আগে দিনে দুইবার মাংস বা ডিম হতো। এখন ডিমও সপ্তাহে একবার। তরকারি কমিয়ে পানি বাড়াই। ছেলেপুলে আগে ভাত খেত দুই বেলা, এখন এক বেলা।”

অভাবের চাপে বাচ্চাদের স্কুল থেকেও বের করে দিতে হয়েছে।

“খরচ সামলানো যাচ্ছে না। ছেলে বলল, আমিও কাজ করব।”

ধার-দেনা আর মহাজনের কিস্তি

আগুনের পর থেকে কয়েক মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়ে আছে।

“মালিক বলেছিল, ‘বোন, দুই মাস মাফ।’ কিন্তু পরে আবার চাপ,”—বললেন সালমা।

স্থানীয় মহাজন থেকে ৫ হাজার টাকা সুদে ধার নিয়েছিলেন, যা সুদে-আসলে এখন ৭ হাজারে পৌঁছেছে।

“মাসে ৫০০ করে শোধ দিই—না পারলে গালাগাল শুনতে হয়।”

পরিবারের মানসিক চাপ

স্বামী আগে রিকশা চালাতেন; এখন ডায়াবেটিসে ভুগে দুর্বল, কাজ করতে পারেন না। সালমা বলেন,

“কাজ নেই, টাকা নেই, খাবার নেই—রাতে স্বামী বলে, ‘মরে যাই।’ আমি বাচ্চাদের জড়িয়ে কাঁদি।”

সহায়তা কেন নেই?

সরকারি ত্রাণ বা সহায়তা পেয়েছেন কি?

“ইউনিয়ন অফিসে গিয়েছিলাম। বলল, নাম নেই। বললাম, নাম ঢোকান—কেউ শুনল না।”

কোনো এনজিওর সহায়তাও মেলেনি।

“একবার এক মেয়ে ৫ কেজি চাল দিল। এরপর আর কেউ আসেনি।”

. স্বপ্নআশা আর বাস্তবতা

এই কারখানাতেই তিনি লাইন ইনচার্জ ছিলেন; নতুন শ্রমিকদের কাজ শেখাতেন।

“কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছি নিজের হাতে বেতন জমিয়ে। এখন নিজের বাচ্চার স্কুলের খরচও দিতে পারি না।”

তবু হাল ছাড়েননি,

“আশা করি আবার কোনো কারখানা খুলবে, আবার কাজ করব। তবে বয়স তো বেড়েছে—নেবে কিনা জানি না।”

সমাজের চোখে

পাড়া-প্রতিবেশীরা সহানুভূতি দেখালেও ধার দিতে রাজি নয়।

“সবাই তো কষ্টে। কারও কাছে চাইলে দেয় না—কারও ঘরে চাল নেই, কীভাবে দেবে?”

 এই শহরে সালমার মতো হাজার হাজার শ্রমিক আছেন। একটি আগুন কেবল কারখানাই নয়, পুড়িয়ে দেয় তাদের স্বপ্নও। বাজারের অগ্নিমূল্যে টিকে থাকতে গিয়ে তাঁরা কম খেয়ে, ধার করে, সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে—যেভাবেই হোক বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। এসব না-শোনা গল্পই আসলে আমাদের শ্রমনির্ভর অর্থনীতির বাস্তব চিত্র—যেখানে একটি দুর্ঘটনা মানেই পুরো একটি পরিবারের জীবন থমকে যাওয়া।