২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান-২ নম্বর এলাকার অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হয়। ১২ ঘণ্টার নজিরবিহীন জিম্মি সংকট শেষে ‘থান্ডারবোল্ট’ অভিযানের মাধ্যমে সেনা কমান্ডোরা জিম্মিদের উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন ইতালীয় নাগরিক—যাদের হত্যাকাণ্ড শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বকে কাঁদিয়েছিল।
ইতালীয় নিহতদের পরিচয় ও সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল
১. ক্লাউডিয়া মারিয়া ডি’আন্তোনা (Claudia Maria D’Antona)
• বয়স: ৫৬
• পেশা: টেক্সটাইল কোম্পানির ঢাকাস্থ প্রতিনিধি
• পরিবার: স্বামী ক্রিশ্চিয়ানো ডি’আন্তোনা, যিনি হামলার সময় প্রাণে বেঁচে যান
• পরিচিতি: বাংলাদেশে ২০ বছরের বেশি কাজের অভিজ্ঞতা; অত্যন্ত পেশাদার ও সবার প্রিয়।
২. ক্রিস্তিয়ান রোসি (Cristian Rossi)
• বয়স: ৪৭
• পেশা: টেক্সটাইল ব্যবসায়ী
• পরিবার: স্ত্রী ও দুটি কন্যাসন্তান
• পরিচিতি: মোদেনা থেকে আসা; সৎ, মৃদুভাষী, দায়বদ্ধ বাবা।
৩. মারিয়া রিভোলতা (Maria Rivolta)
• বয়স: ৩৪
• পেশা: ব্যবসায় প্রতিনিধি
• পরিবার: অবিবাহিত
• পরিচিতি: তরুণ, দক্ষ, সাহসী; কাজের প্রতি ভীষণ নিষ্ঠাবান।
৪. আদেলে পুগলিসি (Adele Puglisi)
• বয়স: ৫৪
• পেশা: টেক্সটাইল ক্রেতা
• পরিচিতি: সিসিলির বাসিন্দা; স্থানীয়দের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
৫. নাদিয়া বেনেদেত্তি (Nadia Benedetti)
• বয়স: ৫২
• পেশা: টেক্সটাইল ব্যবসায়ী
• পরিবার: ইতালিতে স্বামী-সন্তান
• পরিচিতি: সদা হাসিখুশি; বহু বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করতেন।
৬. ভিনসেনজো ডি’অ্যালেস্ত্রো (Vincenzo D’Allestro)
• বয়স: ৪৬
• পেশা: টেক্সটাইল ক্রেতা
• পরিচিতি: ইতালিতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিচিত মুখ।
৭. সিমোনা মন্টি (Simona Monti)
• বয়স: ৩৩
• পেশা: গার্মেন্ট ক্রেতা
• পরিচিতি: সন্তানসম্ভবা ছিলেন; দুই সপ্তাহ পর দেশে ফিরে সন্তান জন্মদানের কথা ছিল।
৮. মার্কো টন্ডাত (Marco Tondat)
• বয়স: ৩৯
• পেশা: টেক্সটাইল ক্রেতা
• পরিচিতি: ফ্রিউলির বাসিন্দা; বন্ধুবৎসল, প্রাণোচ্ছল।
৯. ক্লদিও কাপেল্লি (Claudio Cappelli)
• বয়স: ৪৫
• পেশা: টেক্সটাইল ব্যবসায়ী
• পরিচিতি: শ্রমজীবী পিতার সন্তান; ব্যবসার সুবাদে বাংলাদেশে নিয়মিত আসতেন।
পরিবার ও স্বজনদের মন্তব্য
- ক্লাউডিয়া ডি’আন্তোনার স্বামী ক্রিশ্চিয়ানো বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি ছিল। ওরা সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে,মানুষ হিসেবে নয়।”
• সিমোনা মন্টির বাবা বলেন, “আমার মেয়ে মা হতে যাচ্ছিল। সন্ত্রাসীরা আমার নাতিরও প্রাণ নিয়েছে।”
• নাদিয়া বেনেদেত্তির ভাই বলেন, “ও নিঃশর্ত ভালোবাসা ছড়িয়ে দিত। বাংলাদেশ ওর দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছিল।”
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শোক ও প্রতিবেদন
- BBCলিখেছিল:“Nine Italians who were among the 20 victims in Dhaka’s worst terrorist attack were targeted for being foreigners in a venue popular with diplomats.”
• The Guardian বলেছিল: “The Italian textile industry lost experts who spent decades building ties in Bangladesh’s garment boom.”
• La Repubblica (ইতালি): “Un massacro di innocenti, lavoratori che volevano solo costruire ponti tra i mondi.” (একটি নিষ্পাপ হত্যাকাণ্ড—যারা কেবল দুই বিশ্বের মধ্যে সেতু গড়তে চেয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া ও সম্মান
- ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার নিহতদের স্মরণে আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ করে।
•প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সমবেদনা জানান।
• সরকার ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বয় করে নিহতদের মরদেহ দ্রুত ইতালিতে পাঠায়।
• ২০১৭ সালে গুলশান-২–এর সেই স্থানে নিহতদের নামে স্থাপিত স্মৃতিফলক উদ্বোধন করা হয়, যাতে ইতালীয় নাগরিকদের নাম উল্লিখিত।
এই বছরের (২০২৫) মৃত্যুবার্ষিকী পালন
- ১ জুলাই ২০২৫-এ ঢাকায় ইতালীয় দূতাবাসে এক শোকানুষ্ঠান হয়।
•বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও ঢাকাস্থ ডিএমপির কর্মকর্তারা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
• গুলশানের পুনর্গঠিত সেই স্থানটি এখনও এক শান্ত, নীরব উদ্যান হিসেবে সংরক্ষিত; বিদেশি নাগরিকরা সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যান।
হলি আর্টিজান হামলা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে জঙ্গি সন্ত্রাসের নির্মমতা ও ঘৃণার এক প্রতীক হয়ে আছে। এই হামলায় ইতালীয় নাগরিকদের মৃত্যু বিশেষ করে হৃদয়বিদারক, কারণ তারা ছিলেন বন্ধুপ্রতিম মানুষ, যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছিলেন। তাঁদের স্মৃতি আমাদের সহনশীলতা, শান্তি ও মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা দেয়।