০৮:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

গ্লোবাল সাউথভিত্তিক জোটে চীনের নেতৃত্ব রুখতে পারবে কি ভারত?

গত মাসের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) প্রতিরক্ষা বৈঠক কেবল আসন্ন শরৎকালীন শীর্ষ সম্মেলনের পূর্বাভাস ছিল না; একই সঙ্গে এটি ছিল বৈশ্বিক দক্ষিণকে (গ্লোবাল সাউথ) ক্ষমতায়িত করে বহুধ্রুববিশ্ব গড়ে তোলার বিষয়ে বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক পরীক্ষা।

ব্রিকস—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের জোট—যেমন, তেমনি গ্লোবাল সাউথকেন্দ্রিক এসসিওও চীনের ‘ঘরের মাঠ’ কূটনীতির প্রদর্শনী মঞ্চ।

এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে বেইজিং সাম্রাজ্যবাদ ও একতরফাভাবের নিন্দা করে নিজেকে গ্লোবাল সাউথের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরছে এবং দলটির সঙ্গে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ পরিচয় জোর দিয়ে প্রকাশ করছে।

তবে এসসিও ও ব্রিকস—দুটি জোটেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বসম্মতির প্রয়োজন হয়, আর সেই প্রয়োজনই প্রায়শই গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের আরেক দাবিদার ও দুই জোটেরই সদস্য—ভারতের উপস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

জুনে চীনের শানডং প্রদেশের ছিংদাওয়ে ১০ সদস্যের এসসিওর প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা বসেছিলেন বৈঠকে। ২০২০-এর গালওয়ান উপত্যকার প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এই প্রথম ভারতের রাজনাথ সিংহ চীন সফর করলেন।

এছাড়া মে মাসের কাশ্মির হামলার পর—which কয়েক দশক বদলা হিসেবে বহু ভারতীয় পর্যটক নিহত হন—ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা একই মঞ্চে এটিই তাদের প্রথম উপস্থিতি ছিল। দিল্লি হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করেছিল।

বৈঠকের শেষে সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত ভাষ্য নিয়ে মতানৈক্যের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা যৌথ বিবৃতি দিতে পারেননি বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর ছিংদাওয়ে এসসিওর ওই বৈঠকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ অংশ নেন।

খসড়া বিবৃতিতে কাশ্মিরে এপ্রিলের হামলার কথা বাদ দেওয়া হলেও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার উল্লেখ ছিল—যা পাকিস্তানি ও চীনা স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং যার পেছনে ভারতের মদদ আছে বলে অভিযোগ।

বেইজিং এ বিষয়ে মন্তব্য না করলেও বৈঠককে সফল বলে আখ্যা দিয়েছে; কিন্তু ভারতীয় কয়েকটি মাধ্যম দাবি করেছে, চীন—চেয়ার দেশ হওয়ায়—ঘেঁষা ভাষা বিবৃতিতে ঢুকতে দিয়েছে এবং ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করেছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যৌথ ঘোষণায় ভারতের সমর্থন না দেওয়া চীনের পৃষ্ঠপোষকতাধীন আঞ্চলিক জোটগুলোর ভিতরকার গভীর বিভাজনকে সামনে এনেছে এবং বহুদিন ধরে বেইজিং যে গ্লোবাল সাউথের ঐক্য জোর দিয়েছে, তার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট করেছে।

২০২৩-এ নয়াদিল্লির সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল এসসিও শীর্ষ সম্মেলনেও ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সমর্থন দেয়নি; ফলে ২০৩০ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের দলিলটিও স্বাক্ষরিত হয়নি।

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ঝাং জিয়াদং বলেন, প্রতিরক্ষাবিষয়ক যৌথ বিবৃতিতে ভারতের অসম্মতি চীন-ভারত সহযোগিতার সীমা স্পষ্ট করেছে, যা এসব প্ল্যাটফর্মের কার্যকারিতা দুর্বল করে এবং গ্লোবাল সাউথকে ঐক্যবদ্ধ করার বেইজিংয়ের পরিকল্পনাকেও ক্ষতি করে।

তার মতে, ‘এসসিও হোক বা ব্রিকস—দু’দেশই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে গুরুত্ব দেয়, তাই তাদের সহযোগিতা স্বভাবতই সীমিত। জনসংখ্যা ও অর্থনীতির দিক থেকে চীন-ভারতই গ্লোবাল সাউথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ … তাদের সহযোগিতা ছাড়া জোটটি বড় কিছু অর্জন করতে পারবে না।’

সিগন্যাল ইন্টারভিউতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন ও ভারত উভয়েরই লক্ষ্য গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব, তবে আলাদাভাবে।’ দ্বিপক্ষীয় বিরোধ ছাড়াও বৈচিত্র্যময় গ্লোবাল সাউথের ভেতরে বহু রাজনৈতিক ইস্যুতে মতভেদ রয়েছে।

তিনি উদাহরণ দেন, ‘পাহালগাম হামলার পর অধিকাংশ দেশ সন্ত্রাসবাদ নিন্দা করলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়নি—ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সেটিই ছিল বড় পরীক্ষা।’

২৩ সাল থেকে ভারত ‘ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথ’ নামে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে, যেখানে ১০০-র বেশি দেশ অংশ নেয়, কিন্তু জি-২০ সদস্য না হওয়ায় চীনের অংশগ্রহণ নেই।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীকান্ত কন্দপল্লি বলেন, উভয় দেশই গ্লোবাল সাউথের ঐক্য চায়, তবে তাদের পন্থা আলাদা। বেল্ট অ্যান্ড রোডের মাধ্যমে বেইজিং যতটা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সফল হয়েছে, আফ্রিকার ঋণ-ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে সমালোচনাও এসেছে। ভারত তুলনায় সংযত—‘ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স’ ও ‘ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার’-এর মতো উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও তাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উপস্থিতি সীমিত।

তিনি যোগ করেন, ‘চীনের ছিল বেইজিং কনসেনসাস, ভারতের মুম্বাই কনসেনসাস—এই প্রতিযোগিতাই গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করেছে।’

বেইজিং আফ্রিকায় ‘ঋণ-ফাঁদ’ অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, মহাদেশটির সর্বোচ্চ ঋণ আসলে বহু-পাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও পশ্চিমা বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছে। চীন জাম্বিয়ার ঋণ পুনর্গঠনেও সহায়তা করেছে এবং ১৭টি আফ্রিকান দেশের সুদ-মুক্ত ঋণ মওকুফ করেছে।

বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিন ইয়ে বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় চীন-ভারত টানাপোড়েন স্বাভাবিক; তবে এটা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বহিঃপ্রকাশ’, ‘আমরা-ওরা’ ধাঁচের দ্বন্দ্ব নয়।

তার ভাষ্য, ‘চীনের অপছন্দ সত্ত্বেও ভারত এসসিও ও ব্রিকসে তাদের প্রস্তাবিত নানা উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। এতে চীনের হতাশা হলেও বিষয়টি অপ্রত্যাশিত নয় এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এসসিও একটি অবকাশ তৈরি করে।’

এসসিও-সহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যই আলাপ-আলোচনায় সহায়তা এবং মতবিরোধ জানানো—যা চীনের বহুপাক্ষিক নেতৃত্বের ‘প্রমাণ ও প্রতীক’ হিসেবে তাদের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করলেও কোনো দেশকে নির্ভুল কৌশল জোগায় না।

ইয়ে বলেন, ‘গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো ভিন্ন স্বার্থ ও জোটবদ্ধতা নিয়ে এগোচ্ছে—চীন এককভাবে এদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না; বরং মতপার্থক্যসহ বহুপাক্ষিক বিনিময় সহজতর করতে ইতিবাচক নেতৃত্ব দিতে পারে।’

শাংহাই ইন্সটিটিউটস ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক নিউ হাইবিন উল্লেখ করেন, চীনকে বাদ দিয়ে ভারতের উদ্যোগে গঠিত যেসব ফোরাম (যেমন আইবিএসএ, ডেমোক্রেসি সামিট) ছিল, সেগুলো বৈশ্বিক সমর্থন সীমিতই থেকে গেছে।

বেইজিং এমন আদর্শিক ব্লক তৈরি-চেষ্টাকে প্রায়ই সমালোচনা করে আসছে। নিউ বলেন, ‘আজকের সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক ফোরামগুলো আদর্শিক সামঞ্জস্যের ওপর দাঁড়িয়ে নয়—এটা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর কাছেও পরিষ্কার।’

ব্রিকসের অভিন্ন মুদ্রার প্রস্তাবেও দুই দেশের মতভেদ রয়ে গেছে। ভারত সমর্থন না দিলেও চীন-রাশিয়া মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে উদ্যোগটি এগিয়ে নিয়েছে, আর চীন ব্রিকস সদস্যদের সঙ্গে ইউয়ানের ব্যবহার বাড়িয়েছে।

নিউয়ের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ মেটাতে ভারত হয়তো সীমিত ভূমিকা নিচ্ছে, কিন্তু সহযোগিতা না হলেও সংগঠনের অগ্রগতিতে ক্ষতি হবে না। তাড়াহুড়োর দরকার নেই; কৌশলগত আস্থা গড়ে তুলতে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে ধাপে ধাপে এগোতে হবে।’

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাং সতর্ক করেন, গ্লোবাল সাউথ আপাতত একটি ধারণামাত্র—যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া কঠিন। তিনি বলেন, ‘এই ধারণা বর্তমান ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে গিয়ে নতুন পরিচয় গড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে। কার গ্লোবাল সাউথ মডেল অধিকতর আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে, শেষ পর্যন্ত তারাই বড় প্রভাব খাটাতে পারবে।’

জনপ্রিয় সংবাদ

জেডআই খান পান্নার নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা

গ্লোবাল সাউথভিত্তিক জোটে চীনের নেতৃত্ব রুখতে পারবে কি ভারত?

০৮:০০:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

গত মাসের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) প্রতিরক্ষা বৈঠক কেবল আসন্ন শরৎকালীন শীর্ষ সম্মেলনের পূর্বাভাস ছিল না; একই সঙ্গে এটি ছিল বৈশ্বিক দক্ষিণকে (গ্লোবাল সাউথ) ক্ষমতায়িত করে বহুধ্রুববিশ্ব গড়ে তোলার বিষয়ে বেইজিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক পরীক্ষা।

ব্রিকস—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের জোট—যেমন, তেমনি গ্লোবাল সাউথকেন্দ্রিক এসসিওও চীনের ‘ঘরের মাঠ’ কূটনীতির প্রদর্শনী মঞ্চ।

এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে বেইজিং সাম্রাজ্যবাদ ও একতরফাভাবের নিন্দা করে নিজেকে গ্লোবাল সাউথের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরছে এবং দলটির সঙ্গে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ পরিচয় জোর দিয়ে প্রকাশ করছে।

তবে এসসিও ও ব্রিকস—দুটি জোটেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বসম্মতির প্রয়োজন হয়, আর সেই প্রয়োজনই প্রায়শই গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের আরেক দাবিদার ও দুই জোটেরই সদস্য—ভারতের উপস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

জুনে চীনের শানডং প্রদেশের ছিংদাওয়ে ১০ সদস্যের এসসিওর প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা বসেছিলেন বৈঠকে। ২০২০-এর গালওয়ান উপত্যকার প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এই প্রথম ভারতের রাজনাথ সিংহ চীন সফর করলেন।

এছাড়া মে মাসের কাশ্মির হামলার পর—which কয়েক দশক বদলা হিসেবে বহু ভারতীয় পর্যটক নিহত হন—ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা একই মঞ্চে এটিই তাদের প্রথম উপস্থিতি ছিল। দিল্লি হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করেছিল।

বৈঠকের শেষে সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত ভাষ্য নিয়ে মতানৈক্যের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা যৌথ বিবৃতি দিতে পারেননি বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর ছিংদাওয়ে এসসিওর ওই বৈঠকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ অংশ নেন।

খসড়া বিবৃতিতে কাশ্মিরে এপ্রিলের হামলার কথা বাদ দেওয়া হলেও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার উল্লেখ ছিল—যা পাকিস্তানি ও চীনা স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু করছে এবং যার পেছনে ভারতের মদদ আছে বলে অভিযোগ।

বেইজিং এ বিষয়ে মন্তব্য না করলেও বৈঠককে সফল বলে আখ্যা দিয়েছে; কিন্তু ভারতীয় কয়েকটি মাধ্যম দাবি করেছে, চীন—চেয়ার দেশ হওয়ায়—ঘেঁষা ভাষা বিবৃতিতে ঢুকতে দিয়েছে এবং ভারতের আপত্তি উপেক্ষা করেছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যৌথ ঘোষণায় ভারতের সমর্থন না দেওয়া চীনের পৃষ্ঠপোষকতাধীন আঞ্চলিক জোটগুলোর ভিতরকার গভীর বিভাজনকে সামনে এনেছে এবং বহুদিন ধরে বেইজিং যে গ্লোবাল সাউথের ঐক্য জোর দিয়েছে, তার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট করেছে।

২০২৩-এ নয়াদিল্লির সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল এসসিও শীর্ষ সম্মেলনেও ভারত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে সমর্থন দেয়নি; ফলে ২০৩০ পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়ন কৌশলের দলিলটিও স্বাক্ষরিত হয়নি।

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ঝাং জিয়াদং বলেন, প্রতিরক্ষাবিষয়ক যৌথ বিবৃতিতে ভারতের অসম্মতি চীন-ভারত সহযোগিতার সীমা স্পষ্ট করেছে, যা এসব প্ল্যাটফর্মের কার্যকারিতা দুর্বল করে এবং গ্লোবাল সাউথকে ঐক্যবদ্ধ করার বেইজিংয়ের পরিকল্পনাকেও ক্ষতি করে।

তার মতে, ‘এসসিও হোক বা ব্রিকস—দু’দেশই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে গুরুত্ব দেয়, তাই তাদের সহযোগিতা স্বভাবতই সীমিত। জনসংখ্যা ও অর্থনীতির দিক থেকে চীন-ভারতই গ্লোবাল সাউথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ … তাদের সহযোগিতা ছাড়া জোটটি বড় কিছু অর্জন করতে পারবে না।’

সিগন্যাল ইন্টারভিউতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অমিত রঞ্জন বলেন, ‘চীন ও ভারত উভয়েরই লক্ষ্য গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব, তবে আলাদাভাবে।’ দ্বিপক্ষীয় বিরোধ ছাড়াও বৈচিত্র্যময় গ্লোবাল সাউথের ভেতরে বহু রাজনৈতিক ইস্যুতে মতভেদ রয়েছে।

তিনি উদাহরণ দেন, ‘পাহালগাম হামলার পর অধিকাংশ দেশ সন্ত্রাসবাদ নিন্দা করলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়নি—ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সেটিই ছিল বড় পরীক্ষা।’

২৩ সাল থেকে ভারত ‘ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথ’ নামে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করছে, যেখানে ১০০-র বেশি দেশ অংশ নেয়, কিন্তু জি-২০ সদস্য না হওয়ায় চীনের অংশগ্রহণ নেই।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীকান্ত কন্দপল্লি বলেন, উভয় দেশই গ্লোবাল সাউথের ঐক্য চায়, তবে তাদের পন্থা আলাদা। বেল্ট অ্যান্ড রোডের মাধ্যমে বেইজিং যতটা বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সফল হয়েছে, আফ্রিকার ঋণ-ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে সমালোচনাও এসেছে। ভারত তুলনায় সংযত—‘ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স’ ও ‘ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার’-এর মতো উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও তাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উপস্থিতি সীমিত।

তিনি যোগ করেন, ‘চীনের ছিল বেইজিং কনসেনসাস, ভারতের মুম্বাই কনসেনসাস—এই প্রতিযোগিতাই গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করেছে।’

বেইজিং আফ্রিকায় ‘ঋণ-ফাঁদ’ অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, মহাদেশটির সর্বোচ্চ ঋণ আসলে বহু-পাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও পশ্চিমা বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছে। চীন জাম্বিয়ার ঋণ পুনর্গঠনেও সহায়তা করেছে এবং ১৭টি আফ্রিকান দেশের সুদ-মুক্ত ঋণ মওকুফ করেছে।

বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিন ইয়ে বলেন, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় চীন-ভারত টানাপোড়েন স্বাভাবিক; তবে এটা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বহিঃপ্রকাশ’, ‘আমরা-ওরা’ ধাঁচের দ্বন্দ্ব নয়।

তার ভাষ্য, ‘চীনের অপছন্দ সত্ত্বেও ভারত এসসিও ও ব্রিকসে তাদের প্রস্তাবিত নানা উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে। এতে চীনের হতাশা হলেও বিষয়টি অপ্রত্যাশিত নয় এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এসসিও একটি অবকাশ তৈরি করে।’

এসসিও-সহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যই আলাপ-আলোচনায় সহায়তা এবং মতবিরোধ জানানো—যা চীনের বহুপাক্ষিক নেতৃত্বের ‘প্রমাণ ও প্রতীক’ হিসেবে তাদের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্তিশালী করলেও কোনো দেশকে নির্ভুল কৌশল জোগায় না।

ইয়ে বলেন, ‘গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো ভিন্ন স্বার্থ ও জোটবদ্ধতা নিয়ে এগোচ্ছে—চীন এককভাবে এদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না; বরং মতপার্থক্যসহ বহুপাক্ষিক বিনিময় সহজতর করতে ইতিবাচক নেতৃত্ব দিতে পারে।’

শাংহাই ইন্সটিটিউটস ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক নিউ হাইবিন উল্লেখ করেন, চীনকে বাদ দিয়ে ভারতের উদ্যোগে গঠিত যেসব ফোরাম (যেমন আইবিএসএ, ডেমোক্রেসি সামিট) ছিল, সেগুলো বৈশ্বিক সমর্থন সীমিতই থেকে গেছে।

বেইজিং এমন আদর্শিক ব্লক তৈরি-চেষ্টাকে প্রায়ই সমালোচনা করে আসছে। নিউ বলেন, ‘আজকের সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক ফোরামগুলো আদর্শিক সামঞ্জস্যের ওপর দাঁড়িয়ে নয়—এটা গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর কাছেও পরিষ্কার।’

ব্রিকসের অভিন্ন মুদ্রার প্রস্তাবেও দুই দেশের মতভেদ রয়ে গেছে। ভারত সমর্থন না দিলেও চীন-রাশিয়া মার্কিন ডলারের বিকল্প হিসেবে উদ্যোগটি এগিয়ে নিয়েছে, আর চীন ব্রিকস সদস্যদের সঙ্গে ইউয়ানের ব্যবহার বাড়িয়েছে।

নিউয়ের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ মেটাতে ভারত হয়তো সীমিত ভূমিকা নিচ্ছে, কিন্তু সহযোগিতা না হলেও সংগঠনের অগ্রগতিতে ক্ষতি হবে না। তাড়াহুড়োর দরকার নেই; কৌশলগত আস্থা গড়ে তুলতে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে ধাপে ধাপে এগোতে হবে।’

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাং সতর্ক করেন, গ্লোবাল সাউথ আপাতত একটি ধারণামাত্র—যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া কঠিন। তিনি বলেন, ‘এই ধারণা বর্তমান ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে গিয়ে নতুন পরিচয় গড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে। কার গ্লোবাল সাউথ মডেল অধিকতর আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে, শেষ পর্যন্ত তারাই বড় প্রভাব খাটাতে পারবে।’