পেন্টাগনের একতরফা সিদ্ধান্তে অবাক কূটনীতি মহল
সম্প্রতি পেন্টাগন অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে করা ঐতিহাসিক নিরাপত্তা চুক্তি AUKUS-এর পর্যালোচনা শুরু করে। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল। মূল উদ্দেশ্য বলা হয় ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে চুক্তিটি মানানসই কি না তা দেখা। তবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (NSC) এবং অন্য সংস্থাগুলোকে আগেই কিছু জানানো হয়নি, এমনকি ক্যানবেরা ও লন্ডনের কর্মকর্তারাও বিস্মিত হয়েছেন।
NSC-এর ভেতরের বিশৃঙ্খলা
এই ঘটনা আসলে ট্রাম্প প্রশাসনের এবং বিশেষ করে মে মাসের শুরুতে ভারপ্রাপ্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিওর অধীনে NSC-এর অকার্যকারিতার একটি উদাহরণ। রুবিও দায়িত্ব নেওয়ার পর NSC-এর স্টাফ সংখ্যা অর্ধেকেরও কমিয়ে প্রায় ১০০ জনের নিচে নামিয়ে এনেছেন। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে যেটাকে বলা হয় ‘ইন্টারএজেন্সি প্রসেস’ — যার কাজ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের মধ্যে নীতি সমন্বয় করা।
দুই সূত্রের মতে, এখন সেই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয় না, স্টাফরা জানে না তাদের কি করতে হবে, আর ক্ষমতার শূন্যতা কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যক্তি বা সংস্থা নিজের মতো করে এগিয়ে যায়।
ছোট সমস্যা বড় হওয়ার ঝুঁকি
জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, এই কাঠামো ছোট ছোট সংকটকে অবহেলা করে বড় বিপর্যয়ে পরিণত করতে পারে। ইউক্রেনের মতো অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা থেকে অনেকে বাদ পড়ছে। AUKUS ইস্যু নিয়ে যুক্ত এক সূত্র বলেছে, এখন একে অপরের এলাকায় ক্ষমতার লড়াই চলছে।
“ওইখানে একদম ‘গেম অফ থ্রোনস’ ধরনের রাজনীতি চলছে,” মন্তব্য করেছেন এক কর্মকর্তা।
হোয়াইট হাউসের অবস্থান
হোয়াইট হাউস এই সমালোচনা মানতে চায়নি। তাদের এক কর্মকর্তা বলেছে, এই পরিবর্তন আসলে প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার বাস্তবায়নের জন্যই, এবং যারা তথ্য ফাঁস করতে পারে এমন ক্যারিয়ার স্টাফদের বাদ দেওয়া হয়েছে ইচ্ছে করেই।
পেন্টাগনের AUKUS পর্যালোচনাকেও তেমন কিছু না বলে এড়িয়ে গেছেন হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা, বলেছেন, “সংস্থাগুলো প্রায়ই চুক্তির পরিধি ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে।”
NSC-এর ভূমিকা এবং এর পরিবর্তন
তত্ত্বে NSC সরকারের নীতিনির্ধারণ সমন্বয়ের কেন্দ্র। বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে সবাইকে এক সুরে রাখাই এর কাজ। কিন্তু বাস্তবে NSC অতিরিক্ত বড় হয়ে নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। বাইডেন প্রশাসনের বড় NSC স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ক্ষুব্ধ করেছিল, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে।
রুবিও জানুয়ারি মাসে সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে স্পষ্ট করেছিলেন যে, তিনি চান পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে নেতৃত্ব দিক স্টেট ডিপার্টমেন্ট। ট্রাম্প নিজে NSC-এর ওপর সন্দেহের চোখে দেখতেন, কারণ প্রথম অভিশংসন চলাকালে NSC-এর কিছু স্টাফ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল।
বৈঠকের সংখ্যা ও ধরন কমানো
রুবিওর ছোট করা NSC-এ এখন অনেক কম বৈঠক হয়। NSC-এর অন্তর্গত বিভিন্ন স্তরের কমিটি — প্রিন্সিপালস কমিটি (রুবিও এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা), ডেপুটিস কমিটি (রুবিওর ডেপুটি এবং সংস্থাগুলোর দ্বিতীয় কর্মকর্তা) এবং পলিসি কো-অর্ডিনেশন কমিটি (পিসিসি) — সবখানেই বৈঠক কমে গেছে।
ট্রাম্প ও রুবিওর অধীনে এখন পিসিসি বৈঠক করতে হলেও প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার বিবেচনা করে অনুমোদন নিতে হয়।
সংকটকালে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের মতো বড় সংকটে আসল বৈঠক হয় ওয়েস্ট উইংয়ে। সেসব বৈঠকে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ কিছু সহকারী, রুবিও, হোয়াইট হাউস চিফ অফ স্টাফ সুজি ওয়াইলস থাকেন। ট্রাম্পের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যায় এসব বৈঠকেই। তবে এসব প্রায়ই NSC-এর আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে হয়।
হোয়াইট হাউসের মতে, প্রেসিডেন্ট নিজের মতো করে নীতি নির্ধারণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার সীমিত — তাই NSC-এর কাঠামো এত কমিয়ে দিলে জটিল সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়।
ছোট বৈঠকের গুরুত্ব
পিসিসি বৈঠকগুলো সাধারণত প্রেসিডেন্টের রাডারে না থাকা জটিল বিষয়গুলোতে সমন্বয় করে। এতে ছোট সংকটকে বড় হতে আটকানো যায়। পিসিসি-তে নীচের স্তরের প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়, যা পরে উপরের স্তরে পাঠানো হয়।
এসব বৈঠক বিদেশি কূটনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক দেশ যাদের বিষয় ট্রাম্পের অগ্রাধিকার নয়, তারা এমন মনোযোগকে গুরুত্ব দেয়। এতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায়, যা প্রতিযোগী চীনের প্রস্তাবের পাল্টা হিসেবে কাজে আসে।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
বাইডেন প্রশাসনের সাবেক NSC কর্মকর্তা জশ ব্ল্যাক বলেছেন, “কম বৈঠক খারাপ নয়, কিন্তু সঠিক ভারসাম্য দরকার। অনেককে বাদ দিলে সমস্যাগুলো বড় হওয়ার আগে সমাধান করা যায় না।”
যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য বিষয়ে নজর না দিলে দেশে মহামারি আসতে পারে। মধ্য এশিয়ার উগ্রপন্থা উপেক্ষা করলে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়ে। ফলে নীতি নির্ধারণে সরকার প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়, proactive থাকতে পারে না।
শীর্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি
ট্রাম্প প্রশাসন NSC-কে একদম শীর্ষ থেকে নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু নিচ থেকে উপরের দিকে যাচাই ছাড়া কোনো ধারণা চাপিয়ে দিলে তা বাধার সম্মুখীন হয়। আইনগত জটিলতা বা অন্য নীতির সাথে বিরোধ তৈরি হয়।
উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি দেওয়া যায়। ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর শুল্ক বসিয়ে তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, অথচ একইসাথে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে বলা হয় — যা পরস্পরবিরোধী।
যোগাযোগের শূন্যতা
হোয়াইট হাউস বলছে, নীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। NSC-এ হোয়াইট হাউস কাউন্সেলস অফিসও যুক্ত আছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, রুবিওর পদ্ধতিতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। NSC-এর গুরুত্বপূর্ণ স্টাফরা প্রেসিডেন্টের বৈঠক বা বিদেশি নেতাদের ফোনালাপ থেকে বাদ পড়েন। প্রেসিডেন্ট কি প্রতিশ্রুতি দিলেন তা অনেক সময় পরে বোঝা যায়, যখন আর কিছু করার থাকে না।
হোয়াইট হাউস এর ব্যাখ্যা দিয়েছে নিরাপত্তার কারণে অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়, তবে “অ্যাকশন আইটেম” সবসময় জানানো হয়।
AUKUS পর্যালোচনার ভবিষ্যৎ
কম বৈঠক এবং সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে কিছু সংস্থা নিজের মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন, এলব্রিজ কলবির নেতৃত্বে পেন্টাগন যেভাবে AUKUS পর্যালোচনা শুরু করেছে, যা আগে অন্যদের সাথে সমন্বয় করে করা হতো।
ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই পর্যালোচনার ফলাফল কীভাবে প্রকাশ করা হবে। পেন্টাগন কি অন্য সংস্থা ও দপ্তরকে আগেই জানাবে, যাতে তারা অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের উদ্বিগ্ন কর্মকর্তাদের প্রশ্নের উত্তর প্রস্তুত করতে পারে?
সবশেষে, বিষয়টি নিয়ে একটি NSC বৈঠক করাই বোধ হয় ভালো হবে।