১ জুলাই ২০১৬ রাত প্রায় ৯টা ২০ মিনিটে গুলশান ২–এ অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা ঢুকে গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণ শুরু করলে প্রথম সাড়া দিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সহকারী কমিশনার (এসসি) রবিউল করিম। অতিথি–নিরাপত্তা নিশ্চিতের কয়েক দফা ঢুকেই তিনি জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন।
প্রতিরক্ষায় অনবদ্য সাহস
রবিউল করিম ছিলেন অসাধারণ সাহসিকতার অধিকারী। সহকর্মীরা স্মরণ করেন, “পুলিশ মানেই জনগণের ঢাল”—এই আদর্শ তাঁর প্রাণে বেঁচে ছিল। হামলাকারীদের প্রথম দফার আক্রমণ ঠেকাতে গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখেও তিনি এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় ডোবেন না; তাঁর ত্যাগে কমপক্ষে কয়েকজনের জীবন রক্ষা পেয়েছিল।
মানবতার দায়বদ্ধতা
দায়িত্বপালনের পাশাপাশি মানবসেবায়ও নিবেদিত ছিলেন রবিউল করিম। ২০১১ সালে নিজ গাঁয়ের কাছে ‘Beaconing Light Organisation of Mankind and Society (BLOOMS)’ নামে বিশেষ প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। এছাড়া এর কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে শতাধিক গ্রামবাসী শিশু লেখাপড়া করছে। তার মৃত্যু প্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে দিলেও, আজও এগুলো তার স্বপ্নের আলো জ্বলিয়ে রেখেছে।
বাড়িতে অপরূপ বেদনা-অঞ্জলি
হামলার রাতে আট মাসের গর্ভবতী ছিলেন স্ত্রী উম্মে সালমা। জীবিত ফিরে আসার আশায় তিনি বলেছিলেন, “রাতে ফিরে আসবো।” কিন্তু সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে স্বামীকে হারিয়ে, রাত সাড়ে বারোটার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজে জরুরি সিজারিয়ানে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। নতুন মাখা জীবনের আনন্দ থেমে যায়- ছয় বছর বয়সের বড় সন্তান সাজিদুল করিমের হৃদয়স্পর্শী প্রশ্নে—“আমার আব্বু কোথায়?”।
একাকীত্ব ও সংগ্রাম
স্বামীর মৃত্যুতে দুই সন্তানের জীবিকা চালানোর দায়িত্ব এক হাতে তুলে নেন উম্মে সালমা। ময়নাগুড়ি থেকে ঢাকায় এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তবে চাকরির অনিশ্চয়তা, সন্তানদের পড়াশোনা ও বাড়িভাড়া—সবই তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সন্তানেরা বলেন,
“সামনের পথ কঠিন, কিন্তু আব্বুর দেখানো সেবামূলক স্বপ্ন যাতে থেমে না যায়, তাতেই আমরা প্রাণপণ।”
স্বপ্নপূরণের আকুল আবেদন
রবিউল করিমের অসমাপ্ত মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিবার সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার প্রত্যাশী:
- ব্লুমসে আবাসিক ব্যবস্থা যোগ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত
- প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ
- পরিবারের নিরাপত্তা ও শিক্ষাবৃত্তির জন্য স্থায়ী ভাতা
উম্মে সালমা বলেন,
“ওর ত্যাগ যেন বৃথা না যায়, আমার দুই সন্তান যেন মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়, সে জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।”
এসসি রবিউল করিমের আত্মত্যাগ কোনো ব্যক্তির বীরত্ব নয়, মানবতার প্রতি অটল ভালোবাসার নিদর্শন। তাঁর পরিবারে বেদনা ও সংগ্রাম দেখিয়েছে, সশস্ত্র সেবার পথ কতটা কঠিন হতে পারে। এখন সময় রাষ্ট্র, সমাজ ও সহযোদ্ধাদের—তাদের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে সম্মান জানিয়ে তা বাস্তবায়নের।