০৮:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর নতুন বেতন কমিশন গঠন করবে পরবর্তী সরকার: সালেহউদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাঁচ মামলায় জামিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিতে সহানুভূতির আহ্বান জানালেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার বর্তমান ইন্টারিম সরকার আমলে আইএমএফ পরবর্তী কিস্তি ঋণ দেবে না সার্বিক কৃষি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইউরিয়া ও টিএসপি সার আমদানির অনুমোদন

বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের বিকাশ ও সংকট: বিনোদন নাকি সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার?

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণে নাটক এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল। ঢাকা থেকে জেলা শহর, উপজেলা—সব জায়গায় নাটকের দল তৈরি হয়েছিল। নাটক শুধু বিনোদন নয়, সমাজ-সংস্কার ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনারও মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর একটি নতুন রাষ্ট্র যখন নিজেদের পরিচয় খুঁজছিল, তখন মঞ্চনাটক হয়ে উঠেছিল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, যন্ত্রণা আর সংগ্রামের কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকা থিয়েটার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল, বহুব্রীহি, পদাতিক সহ অসংখ্য দল গড়ে উঠেছিল। শহীদ মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’, সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’, আতাউর রহমানের নির্দেশনা, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, ফারুকী প্রমুখের অভিনয়—এসব বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে আন্তর্জাতিক মানে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

এ সময় দেশের অন্যান্য শহরেও নাট্যচর্চা প্রসারিত হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা সহ অনেক জেলায় নাট্যদল তৈরি হয়। নাট্যোৎসব আয়োজন হতো। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের নাটক মঞ্চস্থ হতো।

কিন্তু এই গৌরবময় যাত্রা কি আজও আগের মতো সমুজ্জ্বল?

মঞ্চনাটকের বর্তমান সংকট

আজকের দিনে নাটকের সেই জোয়ার ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ঢাকায় কিছু দল এখনও কাজ করছে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম। ছোট শহরগুলোতে নাট্যদল টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। সরকার ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কমেছে।

মূল প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এই ট্রেন্ড দিনে দিনে কমছে?

অর্থনৈতিক বাস্তবতা:

নাটক করতে হলে সময়, শ্রম, অর্থ—সহ অনেক কিছুর বিনিয়োগ লাগে। অনেকেই এটি পেশা হিসেবে নিতে চান না কারণ জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন।

স্থান সমস্যা:

ঢাকাতেও পর্যাপ্ত থিয়েটার হল নেই। জেলা শহরে তো নেই-ই। মঞ্চ, আলো, শব্দের মানসম্মত আয়োজন করা খরচসাপেক্ষ।

প্রজন্মান্তরের ব্যবধান:

বড় অংশের তরুণেরা এখন অন্য রকম বিনোদনের প্রতি ঝুঁকেছেন—ফেসবুক, ইউটিউব, ওটিটি কনটেন্ট ইত্যাদিতে।

সোশ্যাল মিডিয়া কি নাটকের বিকল্প?

এখানেই আসে আরও গভীর একটি প্রশ্ন—সোশ্যাল মিডিয়া কি সত্যিই মঞ্চনাটকের বিকল্প হতে পারে?

ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব ভিডিও, ওয়েব সিরিজ—সবই সহজলভ্য। বিনোদন এখানে হাতের মুঠোয়। খুব কম খরচে বানানো যায়, এক ক্লিকেই প্রচার হয়। তরুণেরা নাটকের হলে গিয়ে তিন ঘণ্টা বসতে চান না।

কিন্তু মঞ্চনাটক কেবল বিনোদন নয়।

নাটক মানে দর্শক-অভিনেতার জীবন্ত সংলাপ। সরাসরি চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তোলা। দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলা। হাসানো-কাঁদানো। নাটক সেই লাইভ স্পেস, যেখানে একটি সমাজ নিজের মুখোমুখি হয়।

ইন্টারনেটের কনটেন্টে দ্রুততা, বিনোদনমূলক বৈচিত্র্য আছে—কিন্তু গভীর, সমষ্টিগত, সামাজিক সংলাপের সেই অভিজ্ঞতা নেই।

নাটক কি কেবল বিনোদননাকি সমাজ বদলের হাতিয়ার?

বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাস প্রমাণ করে—নাটক কোনো ফাঁকা বিনোদন নয়।

  • এটি ভাষা আন্দোলন-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয়া সাহসী শিল্প।
    •এটি এক সময় স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিরোধের জায়গা হয়েছে।
    • নাটক জনগণকে অন্যায় দেখিয়েছে, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে।

নাটক যখন থেমে যায়, একটি সমাজ নিজের সমালোচনা করার ক্ষমতা হারায়। মঞ্চনাটক যদি শেষ হয়ে যায়, সমাজও নিজের দর্পণ হারায়।

ফেনীতে 'তোতাকাহিনী' নাটক মঞ্চস্থ – দ্যা মেইল বিডি / খবর সবসময়

সামনে কী করণীয়?

  • সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো দরকার।
    •জেলা-উপজেলায় থিয়েটার হল তৈরি করা প্রয়োজন।
    • স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নাট্যশিক্ষা ও ক্লাবগুলোকে সক্রিয় করা যেতে পারে।
    • অনলাইন মিডিয়াকে শত্রু না ভেবে—তাদের সহযোগী করে ভাবা যায়। যেমন—নাটক রেকর্ড করে ওয়েব মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।

উপসংহার

মঞ্চনাটক কোনো বিলাসিতা নয়—একটি জীবন্ত সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাস।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মঞ্চনাটক সমাজকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে। এই শিল্প যদি মারা যায়, সমাজও হয়ে যাবে নির্বাক।

তাই নাটককে বাঁচানো মানে সমাজকে বাঁচানো।

জনপ্রিয় সংবাদ

বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার

বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের বিকাশ ও সংকট: বিনোদন নাকি সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার?

০৪:০৯:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণে নাটক এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল। ঢাকা থেকে জেলা শহর, উপজেলা—সব জায়গায় নাটকের দল তৈরি হয়েছিল। নাটক শুধু বিনোদন নয়, সমাজ-সংস্কার ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনারও মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর একটি নতুন রাষ্ট্র যখন নিজেদের পরিচয় খুঁজছিল, তখন মঞ্চনাটক হয়ে উঠেছিল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, যন্ত্রণা আর সংগ্রামের কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার পরপরই ঢাকা থিয়েটার, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল, বহুব্রীহি, পদাতিক সহ অসংখ্য দল গড়ে উঠেছিল। শহীদ মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘কবর’, সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’, আতাউর রহমানের নির্দেশনা, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, ফারুকী প্রমুখের অভিনয়—এসব বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে আন্তর্জাতিক মানে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

এ সময় দেশের অন্যান্য শহরেও নাট্যচর্চা প্রসারিত হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, বরিশাল, কুমিল্লা সহ অনেক জেলায় নাট্যদল তৈরি হয়। নাট্যোৎসব আয়োজন হতো। দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের নাটক মঞ্চস্থ হতো।

কিন্তু এই গৌরবময় যাত্রা কি আজও আগের মতো সমুজ্জ্বল?

মঞ্চনাটকের বর্তমান সংকট

আজকের দিনে নাটকের সেই জোয়ার ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ঢাকায় কিছু দল এখনও কাজ করছে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম। ছোট শহরগুলোতে নাট্যদল টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। সরকার ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কমেছে।

মূল প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এই ট্রেন্ড দিনে দিনে কমছে?

অর্থনৈতিক বাস্তবতা:

নাটক করতে হলে সময়, শ্রম, অর্থ—সহ অনেক কিছুর বিনিয়োগ লাগে। অনেকেই এটি পেশা হিসেবে নিতে চান না কারণ জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন।

স্থান সমস্যা:

ঢাকাতেও পর্যাপ্ত থিয়েটার হল নেই। জেলা শহরে তো নেই-ই। মঞ্চ, আলো, শব্দের মানসম্মত আয়োজন করা খরচসাপেক্ষ।

প্রজন্মান্তরের ব্যবধান:

বড় অংশের তরুণেরা এখন অন্য রকম বিনোদনের প্রতি ঝুঁকেছেন—ফেসবুক, ইউটিউব, ওটিটি কনটেন্ট ইত্যাদিতে।

সোশ্যাল মিডিয়া কি নাটকের বিকল্প?

এখানেই আসে আরও গভীর একটি প্রশ্ন—সোশ্যাল মিডিয়া কি সত্যিই মঞ্চনাটকের বিকল্প হতে পারে?

ফেসবুক লাইভ, ইউটিউব ভিডিও, ওয়েব সিরিজ—সবই সহজলভ্য। বিনোদন এখানে হাতের মুঠোয়। খুব কম খরচে বানানো যায়, এক ক্লিকেই প্রচার হয়। তরুণেরা নাটকের হলে গিয়ে তিন ঘণ্টা বসতে চান না।

কিন্তু মঞ্চনাটক কেবল বিনোদন নয়।

নাটক মানে দর্শক-অভিনেতার জীবন্ত সংলাপ। সরাসরি চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তোলা। দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলা। হাসানো-কাঁদানো। নাটক সেই লাইভ স্পেস, যেখানে একটি সমাজ নিজের মুখোমুখি হয়।

ইন্টারনেটের কনটেন্টে দ্রুততা, বিনোদনমূলক বৈচিত্র্য আছে—কিন্তু গভীর, সমষ্টিগত, সামাজিক সংলাপের সেই অভিজ্ঞতা নেই।

নাটক কি কেবল বিনোদননাকি সমাজ বদলের হাতিয়ার?

বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাস প্রমাণ করে—নাটক কোনো ফাঁকা বিনোদন নয়।

  • এটি ভাষা আন্দোলন-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয়া সাহসী শিল্প।
    •এটি এক সময় স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিরোধের জায়গা হয়েছে।
    • নাটক জনগণকে অন্যায় দেখিয়েছে, প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে।

নাটক যখন থেমে যায়, একটি সমাজ নিজের সমালোচনা করার ক্ষমতা হারায়। মঞ্চনাটক যদি শেষ হয়ে যায়, সমাজও নিজের দর্পণ হারায়।

ফেনীতে 'তোতাকাহিনী' নাটক মঞ্চস্থ – দ্যা মেইল বিডি / খবর সবসময়

সামনে কী করণীয়?

  • সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো দরকার।
    •জেলা-উপজেলায় থিয়েটার হল তৈরি করা প্রয়োজন।
    • স্কুল-কলেজ পর্যায়ে নাট্যশিক্ষা ও ক্লাবগুলোকে সক্রিয় করা যেতে পারে।
    • অনলাইন মিডিয়াকে শত্রু না ভেবে—তাদের সহযোগী করে ভাবা যায়। যেমন—নাটক রেকর্ড করে ওয়েব মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।

উপসংহার

মঞ্চনাটক কোনো বিলাসিতা নয়—একটি জীবন্ত সমাজের শ্বাস-প্রশ্বাস।

বাংলাদেশের ইতিহাসে মঞ্চনাটক সমাজকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, ভাবতে শিখিয়েছে। এই শিল্প যদি মারা যায়, সমাজও হয়ে যাবে নির্বাক।

তাই নাটককে বাঁচানো মানে সমাজকে বাঁচানো।