০৯:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
‘আমেরিকার শুল্ক সময়সীমা বাড়ানো হবে না’: ১৪টি দেশকে ট্রাম্প ডলার কি সত্যিই কিং হতে চলেছে ? দুই শত বছরের সাক্ষ্য বহন করা সুরমা নদী ইপিজেড-এর নামে সাঁওতাল কৃষক উচ্ছেদ বন্ধ ও দুর্নীতির তদন্তের দাবি বিবিসির অনুসন্ধানে ৫ই অগাস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের যে চিত্র উঠে এসেছে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে জিএম কাদেরের পাশে- শামীম পাটোয়ারী সীমান্তে ‘পুশ ইন’: যাবতীয় আইন ভেঙেও ভারত কেন এত নির্বিকার? পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা ও মানসিক দৃঢ়তায় শ্রীলঙ্কার সিরিজ জয় রাজনীতি ও রাজধানীতে বস্তিবাসীর প্রভাব, সংকুচিত মধ্যবিত্ত “মানবতার ঢাল: হলি আর্টিজানে জঙ্গী রুখতে এসসি রাবিউল করিমের আত্মত্যাগ”

রেস্তোরাঁর শাটার বন্ধের পেছনের—এক তরুণের কাহিনী

ঢাকার মিরপুরে একটি ছোট রেস্তোরাঁয় কাজ করত জাহিদ (ছদ্মনাম)। বয়স ২৪ বছর। এসএসসি পাস করার পর দুই বছর আগে এই রেস্তোরাঁয় সহকারী বাবুর্চি হিসেবে যোগ দিয়েছিল। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত—১৪ ঘণ্টা টানা কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেত। সেই টাকাতেই চলত মা-বাবা ও ছোট বোনের সংসার। বাবার বয়স বেশি, দিনমজুরির কাজও নেই এখন। পুরো পরিবার জাহিদের বেতনের ওপরই নির্ভর করত।

গত মাসে রেস্তোরাঁটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। মালিক কোনো নোটিশ না দিয়ে একদিন সকালে তালা ঝুলিয়ে দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ঋণ শোধ করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে দিয়েছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, উত্তরা—ঢাকার অনেক এলাকায় একই গল্প। করোনার ধাক্কার পরে আবার এই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি আর ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় শত শত ছোট রেস্তোরাঁ টিকিয়ে রাখতে পারছে না।

অর্থনৈতিক সংকটে রেস্তোরাঁ খাতের বিপর্যয়

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সূত্রে বলা হচ্ছে, গত এক বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। এই খাত থেকে জীবিকা চলত লাখ লাখ কর্মীর। তারা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছে। খাবারের দাম, ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল—সব বেড়ে গেলেও মানুষের হাতে বেশি খরচ করার মতো টাকা নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারও রেস্তোরাঁর বিল বাঁচিয়ে চলছে। ফলে রেস্তোরাঁ ব্যবসা টিকছে না।

জাহিদের চোখে অন্ধকার

জাহিদ বলেন, “যেদিন রেস্তেরাঁ বন্ধ দেখলাম, মাথায় যেন বাজ পড়ল। কোনো দিনই তো বেকার ছিলাম না। দুই বছর ধরে এই দোকানই ছিল আমার সব—ঘরবাড়ির মতো। মালিক ঠিকমতো বেতন দিত। এখন কিছুই নেই।”

বাড়ি ফিরলে মা কাঁদলেন। বোনের স্কুলের বেতন বাকি রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে জাহিদ কাজ খুঁজছেন—একবার রিকশা চালানোর কথা ভাবছেন, আবার হোটেল বা চায়ের দোকানে খোঁজ নিচ্ছেন। তবে সেখানেও অনেকেই কাজ খুঁজছেন। মজুরি কমে গেছে।

জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব

এ ধরনের চাকরি হারানো মানে শুধু আয়ের উৎস বন্ধ হওয়া নয়—পুরো পরিবারের খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষার খরচ, চিকিৎসা সবই সংকটে পড়েছে। জাহিদের বাড়িতে আগে দিনে একবার মাংস, ডাল, শাকসবজি রান্না হতো। এখন ডাল-ভাতেই চলে। বাজারে গেলেই হিসাব করে কিনে আনে—দশ টাকার শাক, পাঁচ টাকার মরিচ।

কর্মসংস্থান ও ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। রেস্তোরাঁ খাতের সংকট মানে শহুরে শ্রমজীবী বহু মানুষের আয় চলে যাওয়া। এই মানুষগুলোকে বিকল্প কর্মসংস্থান দিতে সরকার বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কোনও বড় কর্মসূচি নেই। কিছু এনজিও বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তা মিললেও তা যথেষ্ট নয়। তবে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো—মানুষ সহজে হার মানে না। কেউ চায়ের দোকান দেয়, কেউ রিকশা চালায়, কেউ গার্মেন্টসে ঢোকে। নতুন করে দাঁড়াতে সময় লাগে, মূলধন লাগে, মানসিক চাপও আসে।

সমাজে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এরকম লাখ লাখ তরুণ আয়ের উৎস ছিন্ন হলে শহরের দারিদ্র্য ও অপরাধের ঝুঁকিও বাড়বে। বেকারত্ব মানে হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা। তাই রেস্তোরাঁ খাতের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসাকে বাঁচাতে সহজ শর্তে ঋণ, ভর্তুকি ও নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।

জাহিদ এখনও হাল ছাড়েনি। সে বলে, “কাজ করতেই হবে। ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশা টানলেও টানব। তবে এই কষ্টটা যেন কেউ না পায়।” এই গল্প শুধু জাহিদের নয়—ঢাকার হাজারো যুবকের। অর্থনৈতিক সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁর শাটারগুলোর পেছনে এমনই গল্প জমে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে কি এদের জীবনে আলো ফিরবে? সেটাই বড় প্রশ্ন।

‘আমেরিকার শুল্ক সময়সীমা বাড়ানো হবে না’: ১৪টি দেশকে ট্রাম্প

রেস্তোরাঁর শাটার বন্ধের পেছনের—এক তরুণের কাহিনী

০৪:৪১:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

ঢাকার মিরপুরে একটি ছোট রেস্তোরাঁয় কাজ করত জাহিদ (ছদ্মনাম)। বয়স ২৪ বছর। এসএসসি পাস করার পর দুই বছর আগে এই রেস্তোরাঁয় সহকারী বাবুর্চি হিসেবে যোগ দিয়েছিল। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত—১৪ ঘণ্টা টানা কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেত। সেই টাকাতেই চলত মা-বাবা ও ছোট বোনের সংসার। বাবার বয়স বেশি, দিনমজুরির কাজও নেই এখন। পুরো পরিবার জাহিদের বেতনের ওপরই নির্ভর করত।

গত মাসে রেস্তোরাঁটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। মালিক কোনো নোটিশ না দিয়ে একদিন সকালে তালা ঝুলিয়ে দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ঋণ শোধ করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে দিয়েছেন। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, উত্তরা—ঢাকার অনেক এলাকায় একই গল্প। করোনার ধাক্কার পরে আবার এই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি আর ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় শত শত ছোট রেস্তোরাঁ টিকিয়ে রাখতে পারছে না।

অর্থনৈতিক সংকটে রেস্তোরাঁ খাতের বিপর্যয়

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সূত্রে বলা হচ্ছে, গত এক বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। এই খাত থেকে জীবিকা চলত লাখ লাখ কর্মীর। তারা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছে। খাবারের দাম, ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল—সব বেড়ে গেলেও মানুষের হাতে বেশি খরচ করার মতো টাকা নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারও রেস্তোরাঁর বিল বাঁচিয়ে চলছে। ফলে রেস্তোরাঁ ব্যবসা টিকছে না।

জাহিদের চোখে অন্ধকার

জাহিদ বলেন, “যেদিন রেস্তেরাঁ বন্ধ দেখলাম, মাথায় যেন বাজ পড়ল। কোনো দিনই তো বেকার ছিলাম না। দুই বছর ধরে এই দোকানই ছিল আমার সব—ঘরবাড়ির মতো। মালিক ঠিকমতো বেতন দিত। এখন কিছুই নেই।”

বাড়ি ফিরলে মা কাঁদলেন। বোনের স্কুলের বেতন বাকি রয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে জাহিদ কাজ খুঁজছেন—একবার রিকশা চালানোর কথা ভাবছেন, আবার হোটেল বা চায়ের দোকানে খোঁজ নিচ্ছেন। তবে সেখানেও অনেকেই কাজ খুঁজছেন। মজুরি কমে গেছে।

জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব

এ ধরনের চাকরি হারানো মানে শুধু আয়ের উৎস বন্ধ হওয়া নয়—পুরো পরিবারের খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষার খরচ, চিকিৎসা সবই সংকটে পড়েছে। জাহিদের বাড়িতে আগে দিনে একবার মাংস, ডাল, শাকসবজি রান্না হতো। এখন ডাল-ভাতেই চলে। বাজারে গেলেই হিসাব করে কিনে আনে—দশ টাকার শাক, পাঁচ টাকার মরিচ।

কর্মসংস্থান ও ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবিকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে। রেস্তোরাঁ খাতের সংকট মানে শহুরে শ্রমজীবী বহু মানুষের আয় চলে যাওয়া। এই মানুষগুলোকে বিকল্প কর্মসংস্থান দিতে সরকার বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কোনও বড় কর্মসূচি নেই। কিছু এনজিও বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তা মিললেও তা যথেষ্ট নয়। তবে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো—মানুষ সহজে হার মানে না। কেউ চায়ের দোকান দেয়, কেউ রিকশা চালায়, কেউ গার্মেন্টসে ঢোকে। নতুন করে দাঁড়াতে সময় লাগে, মূলধন লাগে, মানসিক চাপও আসে।

সমাজে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এরকম লাখ লাখ তরুণ আয়ের উৎস ছিন্ন হলে শহরের দারিদ্র্য ও অপরাধের ঝুঁকিও বাড়বে। বেকারত্ব মানে হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা। তাই রেস্তোরাঁ খাতের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসাকে বাঁচাতে সহজ শর্তে ঋণ, ভর্তুকি ও নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।

জাহিদ এখনও হাল ছাড়েনি। সে বলে, “কাজ করতেই হবে। ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশা টানলেও টানব। তবে এই কষ্টটা যেন কেউ না পায়।” এই গল্প শুধু জাহিদের নয়—ঢাকার হাজারো যুবকের। অর্থনৈতিক সংকটে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁর শাটারগুলোর পেছনে এমনই গল্প জমে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে কি এদের জীবনে আলো ফিরবে? সেটাই বড় প্রশ্ন।