সংবাদ সম্মেলনের পটভূমি
১০ জুলাই ২০২৫ সকাল ১১টায় ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে।
আয়োজকরা জানান, তারা দুটি প্রধান বিষয় দেশবাসী ও বিশ্বের মানবিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে চান—
১. বৈষম্যের বিরুদ্ধে গঠিত সংস্কার কমিশন নিয়ে উদ্বেগ
২. দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর চলমান সহিংসতা
বৈষম্যের বিরুদ্ধে কমিশন নিয়ে অভিযোগ
২০২৪ সালের ৮ আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে। কিছু কমিশন ইতিমধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
সংখ্যালঘুদের আশা ছিল, তাদের অধিকার রক্ষায় আলাদা কমিশন হবে বা অন্তত কমিশনগুলোতে তাদের প্রতিনিধি থাকবে। কিন্তু বাস্তবে—
- কোনো আলাদা সংখ্যালঘু কমিশন হয়নি
- বিদ্যমান কমিশনগুলোতেও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি রাখা হয়নি
- এমনকি সংবিধান সংস্কার কমিশনেও সংখ্যালঘুদের জায়গা নেই
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেওয়া লিখিত প্রস্তাবগুলোর বিষয়েও কমিশনগুলোর কোনো আলোচনা হয়নি।
আয়োজকরা বললেন, সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার১০% এর বেশি সংখ্যালঘু অথচ তারা এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় কোনো অংশীদারিত্ব পাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোরও মতামত চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে।
ঐক্য পরিষদ অভিযোগ করে বলেছে—
“এভাবে সংখ্যালঘু বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ না করে বরং তা টিকিয়ে রাখার নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে যায় না।”
তারা ঘোষণা দেন—
“ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা এখন ঐক্যবদ্ধ, সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ।”
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান সহিংসতা
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়—
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে।
২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ৪–২০ আগস্টের মধ্যে ২০১০টি সাম্প্রদায়িক হামলার আংশিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। ঐক্য পরিষদ সরকারের কাছে দাবি করেছিল—
- সহিংসতা বন্ধ
- দায়ীদের গ্রেফতার ও বিচার
- ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন
- আহতদের চিকিৎসা
কিন্তু সরকার সেই রিপোর্টকে ‘মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত’ বলে উড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীতে দেশি-বিদেশি মিডিয়ার রিপোর্ট এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে ১০ ডিসেম্বর ২০২৪-এ সরকার স্বীকার করে যে—
- সহিংসতার কিছু ঘটনা ঘটেছে
- ৮৮টি মামলায় ৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে
সহিংসতার পরিসংখ্যান (২০২৪–২৫)
২১ আগস্ট ২০২৪ – ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ (১৩২ দিনে): ১৭৪টি ঘটনা
- হত্যা: ২৩
- নারী নির্যাতন/ধর্ষণ/গণধর্ষণ: ৯
- উপাসনালয়ে হামলা/ভাঙচুর/লুটপাট/আগুন: ৬৪
- ধর্মঅবমাননা অভিযোগে নির্যাতন/গ্রেফতার: ১৫
- বাড়ি/ব্যবসায় হামলা/লুটপাট/আগুন: ৩৮
- জোরপূর্বক জমি/ব্যবসা দখল: ২৫
জানুয়ারি–৩০ জুন ২০২৫ (৬ মাসে): ২৫৮টি ঘটনা
- হত্যা: ২৭
- নারী নির্যাতন/ধর্ষণ/গণধর্ষণ: ২০
- উপাসনালয়ে হামলা/লুটপাট/আগুন: ৫৯
- ধর্মঅবমাননা অভিযোগে নির্যাতন/গ্রেফতার: ২১
- বাড়ি/ব্যবসায় হামলা/লুটপাট/আগুন: ৮৭
- জোরপূর্বক জমি/ব্যবসা দখল: ১২
- শারীরিক নির্যাতন/জোর করে পদত্যাগ: ৪
- আদিবাসীদের ওপর হামলা: ১২
- ধর্মীয় আচার বাধা/অপহরণ/বিবিধ: ১৬
মোট (৪ আগস্ট ২০২৪–৩০ জুন ২০২৫): ২৪৪২টি ঘটনা
- এই সময়ে ৫০ জন সংখ্যালঘু নিহত
- ২৯ জন নারী ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার
কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ
- যশোরের অভয়নগরে ২০টি সংখ্যালঘু পরিবারের সর্বস্ব লুটপাট ও ঘর পুড়িয়ে দেওয়া
- কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণ করে ভিডিও প্রকাশ
- ঢাকার খিলক্ষেতে মন্দির গুড়িয়ে দেওয়া
- লালমনিরহাটে বাবা-ছেলেকে ধর্মঅপমানের অভিযোগে গণপিটুনি
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে মব তৈরি করে হেনস্থা
- সংখ্যালঘু নেতাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো
সহিংসতার প্রভাব
- নারী, পুরুষ, কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার
- পরিবারগুলো আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে
- মেয়েরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করছে
- আদিবাসীদের অস্তিত্বের দাবি নিয়ে আন্দোলনে হামলা
সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা
- সরকার সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছে
- অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছে না
- এর ফলে দুর্বৃত্তরা দায়মুক্তি পাচ্ছে
- সংখ্যালঘুরা আরও ঝুঁকির মুখে পড়ছে
সংবাদ সম্মেলনের আহ্বান
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সরকারের কাছে আবেদন জানায়—
- বৈষম্য দূর করার জন্য সংখ্যালঘুদের যথাযথ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা
- সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান—অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়া