সন্ত্রাসের সেই রাতের শুরু,
২০১৬ সালের ১ জুলাই, শুক্রবার। সন্ধ্যা তখন সাড়ে সাতটার দিকে। রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের একদম মাথায় অবস্থিত অভিজাত রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারি। বিদেশি কূটনীতিক, ব্যবসায়ী এবং ধনীদের প্রিয় ঠিকানা। রমজান মাসের শেষদিকে হওয়ায় সেখানে অনেকেই ইফতার এবং রাতের খাবারের জন্য জড়ো হয়েছিলেন।
ঠিক সেই সময় পাঁচজন তরুণ, দেশি পোশাকে, কিছুটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে ঢুকে যায় রেস্তোরাঁয়। নিরাপত্তারক্ষী বা সেবাকর্মীরা প্রথমে আঁচই করতে পারেনি যে ওরা সন্ত্রাসী। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিত্র পাল্টে যায় — ওরা ব্যাগ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড, চাপাতি বের করে চিৎকার শুরু করে। আতঙ্কে সবাই ছুটোছুটি শুরু করলে ওরা গুলি ছুঁড়ে কয়েকজনকে সাথে সাথেই হত্যা করে।
জিম্মি নাটকের শুরু
হলি আর্টিজান বেকারির ভিতরে থাকা প্রায় ৩০-৪০ জন অতিথি এবং কর্মীকে সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণে নেয়। বিদেশি অতিথি, বিশেষ করে জাপানি, ইতালিয়ান নাগরিকদের তারা আলাদা করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা কোরান আয়াত পড়তে পারে, তাদের বলা হয় পড়তে। যারা পারছিল, তাদের ছেড়ে দেওয়া বা তুলনামূলক কম নির্যাতন করা হয়।
জিম্মিদের সারি করে বসানো হয়, চোখে কাপড় বেঁধে রাখা হয় অনেকের। একপর্যায়ে কিছু বিদেশিকে নির্দয়ভাবে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা ছিল মধ্যযুগীয় বর্বরতার মতো।
সন্ত্রাসীদের দাবি
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো লিখিত দাবি বেকারির ব্যবস্থাপনা বা পুলিশের কাছে দেয়নি। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিকভাবে বার্তা পাঠানো। তারা IS-এর মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় হামলার দায় স্বীকার করে IS-এর বার্তা প্রচার করা হয়।
মূলত তাদের দাবির কয়েকটি স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল—
বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি।
‘অবিশ্বাসীদের’ (কাফের) হত্যা করে ইসলামী শাসনের শত্রুদের শাস্তি দেওয়া।
পশ্চিমা নাগরিকদের হত্যা করে আন্তর্জাতিক সংবাদে বাংলাদেশকে ‘জিহাদের ফ্রন্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করা।
তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকারকে ইসলামিক স্টেটের দাবির প্রতি গুরুত্ব দিতে বাধ্য করা এবং মুসলিম বিশ্বের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোতে বাংলাদেশি তরুণদের উগ্রপন্থায় উদ্বুদ্ধ করা।
আতঙ্কের দীর্ঘ রাত
রাতভর চলতে থাকে জিম্মি পরিস্থিতি। পুলিশ প্রথমে ঢুকতে গেলে ভারী গুলিবর্ষণ আর গ্রেনেড হামলার মুখে পিছু হটে। রাত এগারটার পর থেকে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ—সব বাহিনী সমন্বিত অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে। আলোচনার চেষ্টা চলে, কিন্তু জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ বা মুক্তি দিতে রাজি হয় না।
জিম্মিদের মধ্যে কয়েকজন রাতের মধ্যেই হত্যার শিকার হন। ভেতরে থাকা অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ফোনে পরিবারকে শেষবারের মতো বিদায় বার্তা পাঠিয়েছিলেন। রেস্তোরাঁর কিচেনে, বাথরুমে, টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকাদের বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর ছিল — কারণ সন্ত্রাসীরা খুঁজে খুঁজে আক্রমণ করছিল।
সমাপনী অভিযান
পরের দিন, ২ জুলাই ভোরে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শুরু হয়। মাত্র ১২-১৩ মিনিটের মধ্যে সেনা কমান্ডোরা ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসীদের পাঁচজনকেই হত্যা করে। ১৩ বিদেশিসহ মোট ২০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগ ইতালিয়ান এবং জাপানি নাগরিক ছিলেন। দুই পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি সালাহউদ্দিন ও এসি রবিউল) হামলার রাতে প্রাথমিক প্রতিরোধের সময় শহীদ হন।
রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিক্রিয়া
হলি আর্টিজান বেকারির হামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বর্বর ও পরিকল্পিত জঙ্গি হামলা হিসেবে চিহ্নিত। এটি পুরো দেশের নিরাপত্তা নীতিকে নাড়িয়ে দেয়। সরকার জঙ্গিবাদ দমনে নতুন কৌশল নেয়। বিদেশি বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক, পর্যটন—সবই প্রভাবিত হয়। মানুষের মনে স্থায়ী ভয় ও ক্ষত তৈরি করে এই হামলা।
গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির সন্ত্রাসী হামলা বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বড় ধাক্কা — যা শুধু নিহতদের পরিবার নয়, পুরো জাতিকে দুঃখ ও শঙ্কায় আচ্ছন্ন করে। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাষ্ট্রকে আতঙ্কিত করা।