নদীর পরিচয় ও উদ্ভব
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য জলরেখা কুশিয়ারা নদীর উৎপত্তি ভারতের মানিপুরের পাহাড়ি উৎস থেকে। এটি বরাক নদীর শাখারূপে শুরু হয়ে শিলচর থেকে দুই শাখায় বিভক্ত হয়—একটি সুরমা, অন্যটি কুশিয়ারা। সিলেট বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই নদী বাংলাদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। দুই শত বছরের ইতিহাসে কুশিয়ারা শুধু জলধারা নয়; এটি এক জীবনধারা। কৃষি, ব্যবসা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য—সবকিছুর শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়েছে এই নদী।
দুই তীরের সভ্যতা ও বনজ সম্পদ
কুশিয়ারার দু’পাড়ে গড়ে উঠেছে শত শত গ্রামের বসতি, যার কৃষিভিত্তিক জনপদ উর্বর পলিমাটির আশীর্বাদে ধান, আখ, শাকসবজি, পান ও সুপারির চাষ করেছে। তীরবর্তী বনভূমিতে আগে প্রচুর বাঁশ, বেত, মেহগনি ও হিজল-করচের মতো গাছের সমাহার ছিল। নদীর ভাঙন ও আধুনিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ফলে অনেক প্রাকৃতিক বনভাগ হারিয়ে গেলেও কিছু জায়গায় আজও সেই সবুজ স্মৃতি বেঁচে আছে।
মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য
কুশিয়ারা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাছের প্রাচুর্য। শোল, ট্যাংরা, বোয়াল, রুই, কাতলা, পাবদা, গুলশা, কৈ ও শিং—এই নদীর শাখা-উপশাখা, খাল-বিল এবং বন্যার মাঠে প্রাকৃতিক প্রজনন করতো। পূর্বে জেলেরা নৌকা বেয়ে রাতে মশাল জ্বেলে মাছ ধরতেন। বর্ষায় নদীর জল বৃদ্ধি পেলে চারপাশের বিল-খাল ভরে যেত, আর সে পানিতে মাছ ছুটে বেড়াত। সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত মাছ শিকারের পাশাপাশি নদীর নাব্য কমে যাওয়া, দূষণ ও বাঁধ নির্মাণের কারণে প্রাকৃতিক মাছের প্রাচুর্য অনেক কমে এসেছে।
বাণিজ্য, যোগাযোগ ও ব্যবসা
ঔপনিবেশিক যুগ এবং পাকিস্তান আমলে কুশিয়ারা নদী পূর্ববঙ্গ ও আসামের মধ্যে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুট ছিল। শিলচর থেকে নৌকায় চা, তুলা, বাঁশ ও চাল রফতানি হতো; বাংলার ব্যবসায়ীরা কুশিয়ারা বেয়ে শিলচর ও কাছাড়ে যেতেন। আসামের চা-কারখানাগুলো তাদের কাঁচামাল এই নদীপথে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতো। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশকেও নদীপথে আমদানি-রফতানি ব্যাপকভাবে চলমান ছিল; সিলেট, মাধবপুর ও শায়েস্তাগঞ্জের দিকে স্থানীয় লঞ্চ এবং বড় নৌকা চালু ছিল।
শহর, বন্দর ও যোগসূত্র
কুশিয়ারা নদী সরাসরি ও শাখা নদীর মাধ্যমে কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। একসময় নদীর বুকে বড় বাণিজ্য নৌকা এবং যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করতো। বিশ শতকের গোড়ায় গড়ে ওঠা বাজারগুলো (যেমন কানাইঘাট, কালীগঞ্জ) নদীকেন্দ্রিক ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছিল। নদীই ছিল এসব হাটের প্রাণ।
তীরের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও গান
কুশিয়ারা নদী শুধুমাত্র অর্থনীতির নয়, সংস্কৃতিরও উৎস। গ্রামীণ শোভাযাত্রা, মুর্শিদি-বাউল সঙ্গীতে বারবার এসেছে নদীর কথা। সিলেটি লোকসাহিত্যে কুশিয়ারা বর্ণিত হয়েছে বীরত্বগাথা, প্রেমকাহিনী ও বেদনার ছোঁয়ায়। বহু পল্লীগীতি লয়ে ছড়িয়ে আছে নদীর কাব্যিক বাণী।
মাজারসংস্কৃতিও নদীর তীরে সমৃদ্ধ। শাহ জালাল (রহ.) ও শাহ পরাণ (রহ.) এর বংশধররা নদীর দু’পাড়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। নদীপথে সুফি-দরবেশরা যাতায়াত করতেন, ফলে এটি আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে পরিণত হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি ও সংকট
বর্তমানে কুশিয়ারার নাব্যতা কমে গেছে; খনন না হওয়ায় অনেক অংশে নৌযান চলাচল বন্ধ। বর্ষায় প্রবল বন্যা দুই তীরের কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত করে, আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকট দেখা দেয়। ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা চলছে, তবে সমাধান হয়নি। ফারাক্কা ও উজানের অন্যান্য বাঁধ নদীর পানিপ্রবাহে প্রভাব ফেলছে। তবুও দুই তীরের মানুষ কৃষি সেচ, মাছ ধরা ও নৌকা চালানোর জন্য নদীর ওপর নির্ভরশীল।
ভবিষ্যৎ ভাবনা
কুশিয়ারা নদীর দুই শত বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা: নদী খনন, পলিমাটি ব্যবস্থাপনা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও সীমান্ত নদী চুক্তি। একসময় যা ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাণশক্তি, সেটি ফিরে পেতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, বাংলাদেশ সরকার এবং সীমান্তপারের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগ জরুরি।
কুশিয়ারা নদী শুধু জল নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনের অনুষঙ্গ। দুই শত বছর ধরে এই নদী গড়ে তুলেছে দুই পাড়ের সভ্যতা। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ঐতিহ্য স্মরণে রেখে নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
কুশিয়ারা বাঁচলে বাঁচবে দুই পাড়ের মানুষ, টিকে থাকবে দুই শত বছরের ঐতিহ্য ও ভালোবাসা।