১০:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

নতুন শিল্প স্থাপনে ঋণপত্র (এল.সি.) খোলার হার কম: শিল্প সম্প্রসারণে কী বার্তা?

গত ছয় মাসে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি ও নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এল.সি.) খোলার প্রবণতা কমেছে। এল.সি. খোলার সংখ্যা ও পরিমাণে এই হ্রাস শিল্প‑সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা দ্বিমত পোষণ করছেন— এটি কি বিনিয়োগ‑পরিকল্পনার বাস্তবায়নের একটি সুপরিকল্পিত ধাপ, নাকি অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন?

এল.সি.‑এর হ্রাসের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য নতুন এল.সি. খোলার সংখ্যা ও আর্থিক মান গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০–২৫ শতাংশ কমেছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, প্লাস্টিক, খাদ্য‑প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন খাতে নতুন উদ্যোক্তারা যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বড় অর্ডার দিচ্ছেন না।

শিল্পপতিদের যুক্তি: পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির সময়

কয়েকজন বড় শিল্প‑গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, এল.সি. খোলা কমার মানে এই নয় যে নতুন শিল্প‑স্থাপনের পরিকল্পনা নেই।বরং তাদের মতে, অনেক উদ্যোক্তা এখন বাজার‑যাচাই, স্থাপনা‑ডিজাইন, অর্থায়ন‑নিশ্চয়তা, জমি‑উন্নয়ন ইত্যাদিতে ব্যস্ত। তারা বলছেন,“যন্ত্রপাতির এল.সি. খোলার আগে একটি বড় প্রস্তুতি লাগে। অনেকেই এখন সেই পর্যায়ে আছেন। হঠাৎ করে সব এল.সি. খুলে ফেলা যৌক্তিক নয়।”

সরকারি ও ব্যাংক‑খাতের ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের তারল্য‑সংকট এবং রিজার্ভ‑ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলো এখন এল.সি. খোলার ক্ষেত্রে কিছুটা বাছাই করছে। বড় এল.সি. সহজে অনুমোদন পেতে কিছু সময় লাগছে। ফলে উদ্যোক্তারাও পরিকল্পনা স্থির করে এল.সি. দাখিলের সময়সূচি নিয়ন্ত্রণ করছেন।

অর্থনীতিবিদদের ভিন্ন মত

অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ বলছেন, এল.সি. কমে যাওয়া মানে সরাসরি নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের শিল্পায়নে বড় বাধা হলো বিনিয়োগের স্থবিরতা। তাদের যুক্তি, “যদি যন্ত্রপাতি আমদানি না হয়, নতুন উৎপাদন‑ক্ষমতা যুক্ত হবে না। কিছু উদ্যোক্তা প্রকল্প স্থগিত করছেন বা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না—এটি স্পষ্টত অর্থনীতির শ্লথতার প্রতিফলন।”

অন্য একটি দল বলছেন, এটি স্বাভাবিক বিনিয়োগ‑চক্রেরই অংশ। তারা মন্তব্য করেন, “সব সময় এল.সি. খোলা একইভাবে হবে না। করোনার পরে এক ধাক্কায় অনেক এল.সি. খোলা হয়েছিল; এখন উদ্যোক্তারা স্থিরভাবে, পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগ করছেন। এটি অর্থনীতির পরিপক্কতার লক্ষণ।”

শিল্প সম্প্রসারণের সম্ভাবনা

শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানাচ্ছে, দেশে এখনো ১০০‑এর বেশি বড় শিল্প‑প্রকল্প অনুমোদনের জন্য লাইসেন্স বা টার্ম‑শিট পর্যায়ে আছে। তাদের মতে, “মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি শেষ পর্যন্ত হবে, তবে হয়তো একবারে নয়—পর্বপর্বে।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এল.সি. কমে যাওয়া শিল্প‑সম্প্রসারণ পুরোপুরি থমকে গেছে তা বোঝায় না। বরং শিল্প‑উদ্যোক্তারা এখন বাজারের চাহিদা, অর্থায়ন‑পরিস্থিতি, বৈদেশিক‑মুদ্রাবাজার ও নীতিগত ঝুঁকি বিবেচনা করে আরও সচেতনভাবে বিনিয়োগ করছেন।

শেষ পর্যন্ত, মূলধনী যন্ত্রপাতির এল.সি. খোলা কমে যাওয়া অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে মিশ্র বার্তা দেয়। একদিকে এটি বিনিয়োগের সতর্কতা ও পরিকল্পনার ইঙ্গিত করে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির উপস্থিতিও তুলে ধরে। বাংলাদেশের শিল্প‑সম্প্রসারণ কী গতিতে এগোবে, তা নির্ভর করবে উদ্যোক্তাদের আস্থা, অর্থায়নের সহজলভ্যতা এবং নীতিনির্ধারকদের সহায়ক পরিবেশ তৈরির ওপর।

নতুন শিল্প স্থাপনে ঋণপত্র (এল.সি.) খোলার হার কম: শিল্প সম্প্রসারণে কী বার্তা?

০৪:৪৪:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

গত ছয় মাসে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি ও নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এল.সি.) খোলার প্রবণতা কমেছে। এল.সি. খোলার সংখ্যা ও পরিমাণে এই হ্রাস শিল্প‑সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা দ্বিমত পোষণ করছেন— এটি কি বিনিয়োগ‑পরিকল্পনার বাস্তবায়নের একটি সুপরিকল্পিত ধাপ, নাকি অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন?

এল.সি.‑এর হ্রাসের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য নতুন এল.সি. খোলার সংখ্যা ও আর্থিক মান গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০–২৫ শতাংশ কমেছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, প্লাস্টিক, খাদ্য‑প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন খাতে নতুন উদ্যোক্তারা যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বড় অর্ডার দিচ্ছেন না।

শিল্পপতিদের যুক্তি: পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির সময়

কয়েকজন বড় শিল্প‑গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, এল.সি. খোলা কমার মানে এই নয় যে নতুন শিল্প‑স্থাপনের পরিকল্পনা নেই।বরং তাদের মতে, অনেক উদ্যোক্তা এখন বাজার‑যাচাই, স্থাপনা‑ডিজাইন, অর্থায়ন‑নিশ্চয়তা, জমি‑উন্নয়ন ইত্যাদিতে ব্যস্ত। তারা বলছেন,“যন্ত্রপাতির এল.সি. খোলার আগে একটি বড় প্রস্তুতি লাগে। অনেকেই এখন সেই পর্যায়ে আছেন। হঠাৎ করে সব এল.সি. খুলে ফেলা যৌক্তিক নয়।”

সরকারি ও ব্যাংক‑খাতের ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের তারল্য‑সংকট এবং রিজার্ভ‑ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলো এখন এল.সি. খোলার ক্ষেত্রে কিছুটা বাছাই করছে। বড় এল.সি. সহজে অনুমোদন পেতে কিছু সময় লাগছে। ফলে উদ্যোক্তারাও পরিকল্পনা স্থির করে এল.সি. দাখিলের সময়সূচি নিয়ন্ত্রণ করছেন।

অর্থনীতিবিদদের ভিন্ন মত

অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ বলছেন, এল.সি. কমে যাওয়া মানে সরাসরি নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের শিল্পায়নে বড় বাধা হলো বিনিয়োগের স্থবিরতা। তাদের যুক্তি, “যদি যন্ত্রপাতি আমদানি না হয়, নতুন উৎপাদন‑ক্ষমতা যুক্ত হবে না। কিছু উদ্যোক্তা প্রকল্প স্থগিত করছেন বা ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না—এটি স্পষ্টত অর্থনীতির শ্লথতার প্রতিফলন।”

অন্য একটি দল বলছেন, এটি স্বাভাবিক বিনিয়োগ‑চক্রেরই অংশ। তারা মন্তব্য করেন, “সব সময় এল.সি. খোলা একইভাবে হবে না। করোনার পরে এক ধাক্কায় অনেক এল.সি. খোলা হয়েছিল; এখন উদ্যোক্তারা স্থিরভাবে, পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগ করছেন। এটি অর্থনীতির পরিপক্কতার লক্ষণ।”

শিল্প সম্প্রসারণের সম্ভাবনা

শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানাচ্ছে, দেশে এখনো ১০০‑এর বেশি বড় শিল্প‑প্রকল্প অনুমোদনের জন্য লাইসেন্স বা টার্ম‑শিট পর্যায়ে আছে। তাদের মতে, “মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি শেষ পর্যন্ত হবে, তবে হয়তো একবারে নয়—পর্বপর্বে।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এল.সি. কমে যাওয়া শিল্প‑সম্প্রসারণ পুরোপুরি থমকে গেছে তা বোঝায় না। বরং শিল্প‑উদ্যোক্তারা এখন বাজারের চাহিদা, অর্থায়ন‑পরিস্থিতি, বৈদেশিক‑মুদ্রাবাজার ও নীতিগত ঝুঁকি বিবেচনা করে আরও সচেতনভাবে বিনিয়োগ করছেন।

শেষ পর্যন্ত, মূলধনী যন্ত্রপাতির এল.সি. খোলা কমে যাওয়া অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে মিশ্র বার্তা দেয়। একদিকে এটি বিনিয়োগের সতর্কতা ও পরিকল্পনার ইঙ্গিত করে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির উপস্থিতিও তুলে ধরে। বাংলাদেশের শিল্প‑সম্প্রসারণ কী গতিতে এগোবে, তা নির্ভর করবে উদ্যোক্তাদের আস্থা, অর্থায়নের সহজলভ্যতা এবং নীতিনির্ধারকদের সহায়ক পরিবেশ তৈরির ওপর।