১২:৪৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫

রাজাকার বাহিনীর অন্ধকার ভূমিকা: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তার নির্মম ইতিহাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এই নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে স্থানীয় সহযোগী বাহিনী—যাদের প্রধান ছিল রাজাকার বাহিনী। পাকিস্তানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকারদের নিয়োগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন ও বাঙালি জনগণকে সন্ত্রস্ত করতে।

রাজাকার বাহিনীর গঠন ও পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনা

১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করা। পাকিস্তান সরকার এই বাহিনীর জন্য নীতিমালা তৈরি করে, অস্ত্র সরবরাহ করে এবং তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে রেখে দমন-পীড়ন পরিচালনায় যুক্ত করে।

রাজাকারদের নিয়োগ করা হতো স্থানীয় জমিদার, মুসলিম লীগ সমর্থক, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে। এদের মধ্যে অনেকে স্থানীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও জানত যে স্থানীয়দের ব্যবহার না করলে তারা গ্রাম-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম দমন করতে পারবে না।

গণহত্যা ও দমন-পীড়নে সহায়তা

রাজাকারদের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকা ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুণ্ঠনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা। তাদের দায়িত্ব ছিল স্থানীয়দের চিনিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানানো, সন্দেহভাজনদের ধরে আনা এবং নির্যাতন করা।

রাজাকাররা স্থানীয় ভাষা, ভূগোল ও সমাজ কাঠামো জানত। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য তাদের সহায়তা ছিল অমূল্য। অনেক ক্ষেত্রে রাজাকাররাই নির্দিষ্ট গ্রাম বা মহল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে গিয়ে গণহত্যা চালাতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী, প্রগতিশীল নেতাকর্মী, শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে টার্গেট করতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে রাজাকারদের অবস্থান

পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন রাজাকার বাহিনীকে সহযোগী বাহিনী হিসেবে বৈধতা দেয়। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, পোশাক ও রেশন দেওয়া হতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খরচে। তারা মিলিশিয়া ফোর্স হিসেবে স্থানীয়ভাবে টহল দিত, গ্রাম পাহারা দিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালাত।

রাজাকার ছাড়াও আল-বদর ও আল-শামস নামের ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সশস্ত্র শাখাগুলিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে গুপ্ত হত্যায় অংশ নিত। রাজাকার বাহিনী ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সরকার-সমর্থিত ‘ভলান্টিয়ার ফোর্স’।

গ্রাম-গঞ্জে পাকিস্তানি শাসন টিকিয়ে রাখতে ভয় ও সন্ত্রাসের রাজনীতি

রাজাকারদের মূল রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেখানে সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারত না, সেসব জায়গায় রাজাকাররা ছিল পাকিস্তানি সরকারের মুখপাত্র। তারা মসজিদে-মসজিদে ভাষণ দিয়ে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ বা ‘হিন্দু ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব ছড়াত, যাতে পাকিস্তানপন্থার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।

এভাবে রাজাকাররা পাকিস্তানি দখলদার শাসনের শাখা-প্রশাখা হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের সহযোগিতায় তারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও স্বাধীনতাপন্থী জনতার ওপর অত্যাচার চালাত।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ

১৯৭১ সালের এই রাজাকার বাহিনী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিচারে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত। তাদের হাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ খুন হয়, অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন, গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বহু রাজাকারের বিরুদ্ধে বিচার হয়েছে এবং শাস্তি হয়েছে।

বেদনা ও ক্ষোভের চিহ্ন

পাকিস্তানি সরকারের রাজাকার বাহিনী ছিল মূলত একটি স্থানীয় সহযোগী বাহিনী, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সহায়তাকারী হিসেবে নিযুক্ত ও পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝার জন্য রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা ও পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পিত দমননীতি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের বেদনা, ক্ষোভ এবং প্রতিরোধের স্মারক হয়ে আছে।

রাজাকার বাহিনীর অন্ধকার ভূমিকা: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তার নির্মম ইতিহাস

০৪:২৭:২৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এই নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে স্থানীয় সহযোগী বাহিনী—যাদের প্রধান ছিল রাজাকার বাহিনী। পাকিস্তানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকারদের নিয়োগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন ও বাঙালি জনগণকে সন্ত্রস্ত করতে।

রাজাকার বাহিনীর গঠন ও পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনা

১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করা। পাকিস্তান সরকার এই বাহিনীর জন্য নীতিমালা তৈরি করে, অস্ত্র সরবরাহ করে এবং তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে রেখে দমন-পীড়ন পরিচালনায় যুক্ত করে।

রাজাকারদের নিয়োগ করা হতো স্থানীয় জমিদার, মুসলিম লীগ সমর্থক, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে। এদের মধ্যে অনেকে স্থানীয় ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও জানত যে স্থানীয়দের ব্যবহার না করলে তারা গ্রাম-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম দমন করতে পারবে না।

গণহত্যা ও দমন-পীড়নে সহায়তা

রাজাকারদের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকা ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুণ্ঠনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করা। তাদের দায়িত্ব ছিল স্থানীয়দের চিনিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানানো, সন্দেহভাজনদের ধরে আনা এবং নির্যাতন করা।

রাজাকাররা স্থানীয় ভাষা, ভূগোল ও সমাজ কাঠামো জানত। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য তাদের সহায়তা ছিল অমূল্য। অনেক ক্ষেত্রে রাজাকাররাই নির্দিষ্ট গ্রাম বা মহল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে গিয়ে গণহত্যা চালাতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী, প্রগতিশীল নেতাকর্মী, শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে টার্গেট করতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে রাজাকারদের অবস্থান

পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন রাজাকার বাহিনীকে সহযোগী বাহিনী হিসেবে বৈধতা দেয়। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, পোশাক ও রেশন দেওয়া হতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খরচে। তারা মিলিশিয়া ফোর্স হিসেবে স্থানীয়ভাবে টহল দিত, গ্রাম পাহারা দিত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালাত।

রাজাকার ছাড়াও আল-বদর ও আল-শামস নামের ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সশস্ত্র শাখাগুলিও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে গুপ্ত হত্যায় অংশ নিত। রাজাকার বাহিনী ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সরকার-সমর্থিত ‘ভলান্টিয়ার ফোর্স’।

গ্রাম-গঞ্জে পাকিস্তানি শাসন টিকিয়ে রাখতে ভয় ও সন্ত্রাসের রাজনীতি

রাজাকারদের মূল রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেখানে সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারত না, সেসব জায়গায় রাজাকাররা ছিল পাকিস্তানি সরকারের মুখপাত্র। তারা মসজিদে-মসজিদে ভাষণ দিয়ে ‘ভারতীয় এজেন্ট’ বা ‘হিন্দু ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব ছড়াত, যাতে পাকিস্তানপন্থার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।

এভাবে রাজাকাররা পাকিস্তানি দখলদার শাসনের শাখা-প্রশাখা হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশের সহযোগিতায় তারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও স্বাধীনতাপন্থী জনতার ওপর অত্যাচার চালাত।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ

১৯৭১ সালের এই রাজাকার বাহিনী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিচারে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত। তাদের হাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ খুন হয়, অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন, গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বহু রাজাকারের বিরুদ্ধে বিচার হয়েছে এবং শাস্তি হয়েছে।

বেদনা ও ক্ষোভের চিহ্ন

পাকিস্তানি সরকারের রাজাকার বাহিনী ছিল মূলত একটি স্থানীয় সহযোগী বাহিনী, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সহায়তাকারী হিসেবে নিযুক্ত ও পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের গণহত্যার ভয়াবহতা বোঝার জন্য রাজাকার বাহিনীর ভূমিকা ও পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পিত দমননীতি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের বেদনা, ক্ষোভ এবং প্রতিরোধের স্মারক হয়ে আছে।