অনলাইন থেকে নিউইয়র্ক ফ্যাশন শো পর্যন্ত
২০১৬ সালে একটি ছোট অনলাইন দোকান থেকে যাত্রা শুরু করে ইন্দোনেশিয়ার ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘বাটনস্কার্ভস’। বর্তমানে এটি জাকার্তা ও কুয়ালালামপুরের বিলাসবহুল শপিং মলে ফিজিক্যাল স্টোর পরিচালনা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করছে।
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী লিন্ডা অ্যাংগ্রিয়া বলেন, “আমরা আমাদের সংগ্রহ টাইমস স্কোয়ার, লন্ডন ও প্যারিসের মতো বৈশ্বিক ফ্যাশন প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শন করেছি। এর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার মডেস্ট ফ্যাশনকে বিশ্বমঞ্চে তোলার আমাদের কৌশল প্রতিফলিত হয়েছে।”
‘মডেস্ট ফ্যাশন‘ ধারণার সম্প্রসারণ
বাটনস্কার্ভস নিজেকে ‘মডেস্ট ফ্যাশন’ নির্মাতা হিসেবে পরিচয় দেয়—যে পোশাক শরীর আচ্ছাদন করে, হিজাব অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে বা না-ও পারে। এটি ‘মুসলিম ফ্যাশন’ শব্দটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন কেবল মুসলিম নয়, বরং সংযত পোশাক পছন্দকারী সব নারীর কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হয়।
দেশীয় বাজারের সংকট ও বৈদেশিক দৃষ্টিপাত
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ার মডেস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো এতদিন অভ্যন্তরীণ বাজারকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু স্বত্বাধিকারের দুর্বল প্রয়োগ, চীনা নকল পণ্যের আগ্রাসন এবং অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে দেশীয় বাজারে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্র্যান্ড প্রতিবেশী মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাইয়ে অনলাইন বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে। তবে তাদের মূল লক্ষ্য এখন মধ্যপ্রাচ্য—যেখানে গুচি, ম্যাক্স মারা ও লুই ভিটনের মতো বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো ইতিমধ্যে মুসলিম দেশগুলোতে মডেস্ট ফ্যাশন চালু করেছে।
লিন্ডা অ্যাংগ্রিয়া বলেন, “আমরা ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আরও প্রবেশ করতে চাই।”
বৈশ্বিক বাজারে সম্ভাবনার উন্মোচন
জাকার্তাভিত্তিক পরামর্শ সংস্থা মার্কামারির প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্কা সোরিয়া বলেন, “প্রিমিয়াম ইন্দোনেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যের সুবিধা রয়েছে।”
রিসার্চ প্রতিষ্ঠান দিনারস্ট্যান্ডার্ডের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মডেস্ট ফ্যাশনে মুসলমানরা ব্যয় করেছে আনুমানিক ৩২৬.৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৮ শতাংশ বেশি। এই বাজার ২০২৮ সালের মধ্যে ৫.৮ শতাংশ হারে বেড়ে ৪৩৩.৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
২০২৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিল মডেস্ট ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক, এরপর সৌদি আরব, কাজাখস্তান, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া। চীন ছিল সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক, যার পরে ছিল ইতালি, তুরস্ক, ভিয়েতনাম ও ভারত। ইন্দোনেশিয়া ২০২২ সালের নবম স্থান থেকে ২০২৩ সালে সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে।
ডিজাইনের আধুনিকীকরণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের উপযোগিতা
সোরিয়া বলেন, “ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিভাবান ডিজাইনারের অভাব নেই, তবে অনেক ডিজাইন অভ্যন্তরীণ রুচির জন্য খুব বেশি জাঁকালো, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে কম গ্রহণযোগ্য।”
তিনি বলেন, “আপনি যদি বিক্রেতা হন, তবে বাজারের রুচি বুঝতে হবে। সৃজনশীলতায় ইন্দোনেশিয়া সবার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে, কিন্তু ডিজাইন যদি বাজার উপযোগী না হয়, তাহলে সফলতা সম্ভব নয়।”
তবে এই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। বাটনস্কার্ভস এখন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছেও সরাসরি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে।
লিন্ডা অ্যাংগ্রিয়া বলেন, “আমরা এমন ডিজাইন তৈরি করি যা বাস্তব জীবনের প্রয়োজন মেটায় এবং আধুনিক নারীর গতিশীল জীবনযাত্রার সাথে মানানসই। যেমন আমাদের ননস্লিপ স্কার্ফ ও রূপান্তরযোগ্য ব্যাগ।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো কখনোই স্থানীয় সংস্কৃতি ও নারীদের অনুভূতি এত গভীরভাবে বোঝে না—আমরা শুধু পণ্য বিক্রি করছি না, বরং এমন নারীদের সেবা দিচ্ছি যারা ট্রেন্ডের সঙ্গে থেকে নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকতে চান।”
সরকার ও উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ
২০২৪ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক মডেস্ট ফ্যাশন উৎসবে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু ডিজাইনার তাদের সংগ্রহ উপস্থাপন করেন।
আরেক ইন্দোনেশীয় ব্র্যান্ড ‘দিনিরা’র ডিজাইনার দিনি প্রতিভি ইরাওয়াতি বলেন, “দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো উচ্চমানের ডিজাইনকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে তুলে ধরছে, যা মধ্যবিত্তদের কাছে জনপ্রিয়।”
তিনি জানান, দিনিরার অধিকাংশ ক্রেতা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা: আন্তর্জাতিক বিস্তার
মার্কামারি ইন্দোনেশিয়ার ব্র্যান্ডগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়তা করছে। তারা বিদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণ করার কৌশল শেখাচ্ছে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর ফ্যাশন শোতেও অংশ নিচ্ছে।
২০২৫ সালে তারা আবু ধাবি ও ইস্তানবুলে পপ-আপ স্টোর চালু করতে যাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে একটি মাল্টিব্র্যান্ড স্টোর চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে—সম্ভবত নিউ জার্সিতে, যেখানে বড় মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে।
সোরিয়া বলেন, “অনেক ভালো স্থানীয় ব্র্যান্ড আছে, কিন্তু বিদেশে নিজস্ব স্টোর খোলার আর্থিক সামর্থ্য এখনো তাদের নেই। আমরা সেই সেতু তৈরি করছি।”