নদীর পরিচয় ও উৎপত্তিস্থল
পুনর্ভবা নদী দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী, যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর অংশে বিস্তৃত। নদীটির উৎপত্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জের নিকটে, রায়গঞ্জ বনের একটি জলাভূমি অঞ্চল থেকে। সেখান থেকে এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটি একটি আন্তঃসীমান্ত নদী, যার স্রোতধারা দুই দেশের মাঝখান দিয়ে ভাগাভাগি হয়ে চলেছে—অর্ধেক ভারত, অর্ধেক বাংলাদেশ।
২০০ বছরের ইতিহাস ও নদীর সভ্যতা
গত দুই শতাব্দী ধরে পুনর্ভবা নদী উত্তরবঙ্গের কৃষিনির্ভর জনগণের জীবন ও অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে আসছে। প্রাচীনকালে নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল কৃষিনির্ভর জনপদ, যেগুলোর প্রধান পেশা ছিল কৃষি ও মাছ ধরা। নদীটি ছিল ফসলের সেচের প্রধান উৎস, আর বর্ষাকালে নদীর পানিতে উর্বরতা ছড়িয়ে পড়ত পার্শ্ববর্তী মাঠে। নদীর তীরে গড়ে ওঠে ছোট ছোট বাজার ও হাট—যা পরে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
উপনদী ও সংযোগ: টাঙন ও আত্রাই
পুনর্ভবা নদীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে টাঙন নদীর, যা মূলত দিনাজপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুনর্ভবার একটি উপনদীতে পরিণত হয়। অপরদিকে, এই নদীর স্রোতধারা শেষে মিশে যায় আত্রাই নদীতে, যা আবার অনেক নদীর মিলনস্থল। আত্রাই নদীর সঙ্গে পুনর্ভবার এ সম্পর্কই নদীর আঞ্চলিক জলপ্রবাহে প্রভাব ফেলে এবং বর্ষা মৌসুমে প্লাবনের সম্ভাবনা বাড়ায়।
দিনাজপুর ও কাচন রেলওয়ে সেতু
দিনাজপুর শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত পুনর্ভবা নদীর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হলো কাচন রেলওয়ে সেতু। এটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয়, যা আজও একটি কার্যকর রেলযোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এই সেতু নদীর গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক কার্যকারিতার প্রমাণ, যেখান দিয়ে একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রেন চলাচল করত।
বনজ সম্পদ ও মাছের বৈচিত্র্য
নদীটির তীরে একসময় ঘন বনাঞ্চল ছিল। আজ সেই বন অনেকাংশে হারিয়ে গেলেও, কিছু প্রাকৃতিক বন এখনও বিদ্যমান, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নদীতে পাওয়া যেত নানা রকম দেশীয় মাছ—রুই, কাতলা, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, শিং, মাগুরসহ আরো অনেক প্রজাতি। যদিও এখন নদী শুকিয়ে যাওয়া, দূষণ এবং অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে মৎস্য সম্পদ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
পোরশা বিল ও পুনর্ভবার সম্পর্ক
নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলায় অবস্থিত বিশাল পোরশা বিলের সঙ্গে পুনর্ভবা নদীর রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বর্ষাকালে পুনর্ভবা নদীর পানি পোরশা বিলে প্রবাহিত হয়ে বিলটিকে প্লাবিত করে। এতে বিল অঞ্চলের কৃষিজমি উর্বর হয় এবং মাছের উৎপাদনও বাড়ে। বিল-নদী এই সহাবস্থান মানুষের জীবিকা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে নদী ও বাণিজ্য
ব্রিটিশ শাসনামলে পুনর্ভবা নদীকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট নৌবন্দর গড়ে উঠেছিল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে চলত নৌপথে চাল, গম, তেলবীজ, পাট ও অন্যান্য পণ্য আদান-প্রদান। পাকিস্তান আমলেও নদীটি একটি সক্রিয় বাণিজ্যিক জলপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে নদীপথের গুরুত্ব কমলেও এখনও সীমান্ত অঞ্চলে এই নদীর মাধ্যমে কিছু পরিমাণ পণ্য আসা-যাওয়া করে।
দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংযোগ
পুনর্ভবা নদীর মাধ্যমে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে কলকাতা, রাজশাহী, রংপুর ও অন্যান্য শহরের বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপন সম্ভব হতো। ভারতীয় অংশ দিয়ে নদীপথে কৃষিপণ্য কলকাতা বন্দরে নিয়ে যাওয়া হতো, এবং সেখান থেকে বিদেশে রপ্তানিও সম্ভব ছিল। যদিও এই ধারাটি এখন বিলুপ্তপ্রায়, তবুও নদীর ইতিহাসে তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
সংস্কৃতি, সাহিত্যে পুনর্ভবা
পুনর্ভবা নদী কেবল একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়, বরং এটি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও অংশ। নদীর পাড় ঘেঁষে রচিত হয়েছে বহু লোককথা, গান ও কবিতা। স্থানীয় বাউল ও ভাটিয়ালি গানে পুনর্ভবার জলের কথা, প্রেম-বিরহের কথা উঠে এসেছে। কথিত আছে, দিনাজপুর অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকরা বারবার এই নদীকে কেন্দ্র করে তাদের রচনায় প্রকৃতির রূপ ও মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন।
নদীর বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে পুনর্ভবা নদী নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। পানি প্রবাহ কমে এসেছে, দূষণের মাত্রা বেড়েছে, অপরিকল্পিত বাঁধ ও দখলের কারণে নদীর প্রাকৃতিক গঠন বিপর্যস্ত হয়েছে। তবে নদীর ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এনে যৌথভাবে ভারত-বাংলাদেশ উদ্যোগে নদী সংরক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করলে, পুনর্ভবা আবারও হয়ে উঠতে পারে দুই দেশের জল, জীবন ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধ।
অস্তিত্বের গল্প
পুনর্ভবা নদী কেবলমাত্র একটি নদী নয়—এটি ইতিহাস, সভ্যতা, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির ধারক। এর দুই তীরের জীবনের বুননেই ফুটে উঠেছে বাঙালির হাজার বছরের অস্তিত্বের গল্প। সেই গল্প এখনও প্রবাহমান, তবে প্রয়োজন সচেতনতা, সংরক্ষণ ও নতুনভাবে নদীকে ঘিরে উন্নয়নের পরিকল্পনা। পুনর্ভবা তখনই সত্যিকার অর্থে ‘পুনরায় জীবন্ত’ হবে।