০২:১৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

টিকটকে ব্যর্থ প্রচারণা ও জাপানে রাজনীতির রূপান্তরকাল

টিকটকে এলডিপির বিভ্রান্ত আত্মপ্রকাশ

জাপানের দীর্ঘদিনের শাসক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) সম্প্রতি টিকটকে ৬৮ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর একটি ৪৪-সেকেন্ডের ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে তিনি পেট্রলের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই ভিডিওতে তরুণদের আকর্ষণ করার মতো কিছু ছিল না—তারা যাকে বলে “রিজ” (মার্জিত আবেদন)। স্বাভাবিকভাবেই ভিডিওটি ব্যর্থ হয়।

এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, জাপানি রাজনীতিতে এখন এক বিশৃঙ্খল পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। ২০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য উচ্চকক্ষের নির্বাচন এই নতুন বাস্তবতায় এলডিপির মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার বড় পরীক্ষা।

এলডিপির ইতিহাস ও বর্তমান সংকট

১৯৫৫ সালে এলডিপি দুটি রক্ষণশীল দলের একত্রিকরণে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থার সুবিধা, নীতিনির্ধারণী নমনীয়তা ও ‘পর্ক-ব্যারেল’ বাজেটের মাধ্যমে দলটি শাসন ধরে রাখে। ১৯৯৩ ও ২০০৯ সালে তারা স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা হারালেও, প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান (ডিপিজে) ২০১১ সালের ভূমিকম্প, সুনামি ও পারমাণবিক দুর্ঘটনার সময় ক্ষমতায় থাকায় আস্থাহীনতায় পড়ে।

২০১২ সালে শিনজো আবের নেতৃত্বে এলডিপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ২০২২ সালে আবের হত্যাকাণ্ডের পর দলের পরিস্থিতি বদলে যায়। ২০২৩-২৪ সালের অর্থ কেলেঙ্কারিতে এলডিপির ফ্যাকশনভিত্তিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, যা আগে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য সামাল দিতে সহায়ক ছিল। এর ফলে দলটি হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল।

ইতিহাসে প্রথম সংখ্যালঘু সরকার

গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এলডিপি ও কোমেইতো একত্রে নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এর ফলে এলডিপিকে প্রথমবারের মতো সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হয়। উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখাও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই নির্বাচনে ২৪৮টি আসনের মধ্যে ১২৫টি আসনে ভোট হচ্ছে। বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে এলডিপি ও কোমেইতোকে অন্তত ৫০টি আসনে জয়ী হতে হবে। তারা বর্তমানে এই ১২৫টির মধ্যে ৬৬টি আসন ধরে রেখেছে। যদি তারা ৫০-এর নিচে নেমে যায়, তবে ইশিবার পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হবে।

নতুন দল ও ডিজিটাল মাধ্যমের উত্থান

নতুন ও ছোট দলগুলো এলডিপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। ডানপন্থী DIY পার্টি (সানসেইতো) অভিবাসনবিরোধী “জাপানিজ ফার্স্ট” বার্তা দিয়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ইশিন পার্টি ওসাকা-কেন্দ্রিক শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছে।

বামপন্থী রেইওয়া শিনসেংগুমি ভোক্তা কর বাতিলসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং পুরোনো বাম দলগুলো থেকে ভোট টানার চেষ্টা করছে। তবে সবচেয়ে সফল ছোট দল হলো ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিএফপি)। তারা পপুলিজম ও প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যপন্থার মিশ্রণে তরুণ ও কর্মক্ষম জনগণকে টার্গেট করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলটির আসন চার গুণ বেড়ে ২৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এলডিপি ১৯৬টি আসন পেলেও অনেক বিল পাস করাতে ডিপিএফপির সহায়তা নিতে হয়েছে।

তরুণদের প্ল্যাটফর্মে এলডিপির পশ্চাৎপদতা

জাপানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব আগে ধীরগতিতে বাড়লেও এখন তা তরুণদের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ৭০-এর বেশি বয়সীদের মধ্যে ৭৫% এনএইচকে-তে আস্থা রাখে, অথচ ২০-এর ঘরের তরুণদের মধ্যে তা ৪০%-এরও নিচে। তরুণরা ইউটিউব, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে বেশি সক্রিয়, যেখানে ডিপিএফপি ও অন্যান্য নতুন দল এলডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে।

এলডিপির এক তরুণ সদস্য স্বীকার করেন, “দলটি পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী এবং সময়ের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়।” এলডিপির প্রবীণ নেতারা এখনো টোকিওর ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টের ধোঁয়াটে ঘরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

সম্ভাবনা এখনও বিদ্যমান

তবে এলডিপি এখনো পুরোপুরি পরাজিত নয়। দলের ভেতরে দক্ষ ও তরুণ নেতারা রয়েছেন। তারা যদি নতুন নেতৃত্বে কাউকে সামনে আনতে পারে, তবে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে। এলডিপির স্থানীয় নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এখনো অন্যান্য দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।

২০২২ সালে এলডিপির জনসমর্থন ছিল প্রায় ৪০%। বর্তমানে তা ৩০%-এর নিচে নেমে এসেছে। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দলই ১০%-এর বেশি সমর্থন পায়নি।

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

এই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জাপানের জন্য ইতিবাচক দিকও সৃষ্টি করতে পারে। সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা দলগুলোকে জনগণের চাহিদার প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। তবে একটি ভিন্ন ভবিষ্যৎও সম্ভব—দ্রুত পরিবর্তনশীল জোট সরকার, স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং দুর্বল নীতিনির্ধারণী কাঠামো।

প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আর এলডিপি ভোটারদের নগদ সহায়তা দিচ্ছে—এই ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি জাপানের আর্থিক শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাজেট নিয়ে সংখ্যালঘু সরকারের দরকষাকষিকে এলডিপির এক প্রবীণ নেতা “পাগলামি” বলে উল্লেখ করেছেন। সামনে পরিস্থিতি আরও অস্থির হতে পারে।

টিকটকে ব্যর্থ প্রচারণা ও জাপানে রাজনীতির রূপান্তরকাল

০৮:০০:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫

টিকটকে এলডিপির বিভ্রান্ত আত্মপ্রকাশ

জাপানের দীর্ঘদিনের শাসক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) সম্প্রতি টিকটকে ৬৮ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর একটি ৪৪-সেকেন্ডের ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে তিনি পেট্রলের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই ভিডিওতে তরুণদের আকর্ষণ করার মতো কিছু ছিল না—তারা যাকে বলে “রিজ” (মার্জিত আবেদন)। স্বাভাবিকভাবেই ভিডিওটি ব্যর্থ হয়।

এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, জাপানি রাজনীতিতে এখন এক বিশৃঙ্খল পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে। ২০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য উচ্চকক্ষের নির্বাচন এই নতুন বাস্তবতায় এলডিপির মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার বড় পরীক্ষা।

এলডিপির ইতিহাস ও বর্তমান সংকট

১৯৫৫ সালে এলডিপি দুটি রক্ষণশীল দলের একত্রিকরণে প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থার সুবিধা, নীতিনির্ধারণী নমনীয়তা ও ‘পর্ক-ব্যারেল’ বাজেটের মাধ্যমে দলটি শাসন ধরে রাখে। ১৯৯৩ ও ২০০৯ সালে তারা স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতা হারালেও, প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব জাপান (ডিপিজে) ২০১১ সালের ভূমিকম্প, সুনামি ও পারমাণবিক দুর্ঘটনার সময় ক্ষমতায় থাকায় আস্থাহীনতায় পড়ে।

২০১২ সালে শিনজো আবের নেতৃত্বে এলডিপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ২০২২ সালে আবের হত্যাকাণ্ডের পর দলের পরিস্থিতি বদলে যায়। ২০২৩-২৪ সালের অর্থ কেলেঙ্কারিতে এলডিপির ফ্যাকশনভিত্তিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, যা আগে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য সামাল দিতে সহায়ক ছিল। এর ফলে দলটি হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল।

ইতিহাসে প্রথম সংখ্যালঘু সরকার

গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এলডিপি ও কোমেইতো একত্রে নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এর ফলে এলডিপিকে প্রথমবারের মতো সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হয়। উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখাও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই নির্বাচনে ২৪৮টি আসনের মধ্যে ১২৫টি আসনে ভোট হচ্ছে। বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে এলডিপি ও কোমেইতোকে অন্তত ৫০টি আসনে জয়ী হতে হবে। তারা বর্তমানে এই ১২৫টির মধ্যে ৬৬টি আসন ধরে রেখেছে। যদি তারা ৫০-এর নিচে নেমে যায়, তবে ইশিবার পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হবে।

নতুন দল ও ডিজিটাল মাধ্যমের উত্থান

নতুন ও ছোট দলগুলো এলডিপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। ডানপন্থী DIY পার্টি (সানসেইতো) অভিবাসনবিরোধী “জাপানিজ ফার্স্ট” বার্তা দিয়ে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ইশিন পার্টি ওসাকা-কেন্দ্রিক শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছে।

বামপন্থী রেইওয়া শিনসেংগুমি ভোক্তা কর বাতিলসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং পুরোনো বাম দলগুলো থেকে ভোট টানার চেষ্টা করছে। তবে সবচেয়ে সফল ছোট দল হলো ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর দ্য পিপল (ডিপিএফপি)। তারা পপুলিজম ও প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যপন্থার মিশ্রণে তরুণ ও কর্মক্ষম জনগণকে টার্গেট করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলটির আসন চার গুণ বেড়ে ২৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এলডিপি ১৯৬টি আসন পেলেও অনেক বিল পাস করাতে ডিপিএফপির সহায়তা নিতে হয়েছে।

তরুণদের প্ল্যাটফর্মে এলডিপির পশ্চাৎপদতা

জাপানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব আগে ধীরগতিতে বাড়লেও এখন তা তরুণদের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ৭০-এর বেশি বয়সীদের মধ্যে ৭৫% এনএইচকে-তে আস্থা রাখে, অথচ ২০-এর ঘরের তরুণদের মধ্যে তা ৪০%-এরও নিচে। তরুণরা ইউটিউব, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামে বেশি সক্রিয়, যেখানে ডিপিএফপি ও অন্যান্য নতুন দল এলডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে।

এলডিপির এক তরুণ সদস্য স্বীকার করেন, “দলটি পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী এবং সময়ের চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়।” এলডিপির প্রবীণ নেতারা এখনো টোকিওর ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টের ধোঁয়াটে ঘরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

সম্ভাবনা এখনও বিদ্যমান

তবে এলডিপি এখনো পুরোপুরি পরাজিত নয়। দলের ভেতরে দক্ষ ও তরুণ নেতারা রয়েছেন। তারা যদি নতুন নেতৃত্বে কাউকে সামনে আনতে পারে, তবে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে। এলডিপির স্থানীয় নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এখনো অন্যান্য দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।

২০২২ সালে এলডিপির জনসমর্থন ছিল প্রায় ৪০%। বর্তমানে তা ৩০%-এর নিচে নেমে এসেছে। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দলই ১০%-এর বেশি সমর্থন পায়নি।

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

এই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জাপানের জন্য ইতিবাচক দিকও সৃষ্টি করতে পারে। সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা দলগুলোকে জনগণের চাহিদার প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। তবে একটি ভিন্ন ভবিষ্যৎও সম্ভব—দ্রুত পরিবর্তনশীল জোট সরকার, স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং দুর্বল নীতিনির্ধারণী কাঠামো।

প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, আর এলডিপি ভোটারদের নগদ সহায়তা দিচ্ছে—এই ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি জাপানের আর্থিক শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাজেট নিয়ে সংখ্যালঘু সরকারের দরকষাকষিকে এলডিপির এক প্রবীণ নেতা “পাগলামি” বলে উল্লেখ করেছেন। সামনে পরিস্থিতি আরও অস্থির হতে পারে।