কায়াহ (কারেন্নি) অঙ্গরাজ্যে যুদ্ধের দৈনন্দিন বাস্তবতা
কায়াহ অঙ্গরাজ্যের (পূর্বে কারেন্নি) পাহাড়ি, দুর্গম অরণ্য আজ বিদ্রোহী বাহিনী, সেনা বন্দি ও বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করছে। কারও জন্য এটি সামরিক যুদ্ধক্ষেত্র, কারও জন্য কারাগার, আবার বহু মানুষের কাছে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়। ডেমোসো এলাকার উপকণ্ঠে সাম্প্রতিক বোমা হামলার পর একটি নবনির্মিত হাসপাতালকে আরও গোপন স্থানে স্থানান্তরের ভাবনা চলছে; চিকিৎসক অং মিয়াত মিয়াতের মতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বারবার হামলার ঝুঁকিতে।
কুপ ও সামরিক সংঘাতের প্রেক্ষাপট
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারজুড়ে তীব্র গৃহযুদ্ধ অব্যাহত। থাইল্যান্ড সীমান্তঘেঁষা কায়াহ এখন প্রধান সংঘর্ষমঞ্চগুলোর একটি। জাতিসংঘের হিসাবে অন্তত সাড়ে তিন মিলিয়ন (সম্ভাব্য দ্বিগুণ) মানুষ বাস্তুচ্যুত—প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু। দুই কোটিরও বেশি অসামরিক মানুষ মানবিক সহায়তার প্রয়োজনের মধ্যে। অসংখ্য নিহত ও আহতের পাশাপাশি সামরিক জান্তার (স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল) বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের নথিভুক্ত অভিযোগ বেড়েই চলেছে। ২০২৫ সালের মার্চের ভূমিকম্পের পর ঘোষিত অস্ত্রবিরতির বাস্তব প্রয়োগ সীমিত; প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি অব্যাহত।
বিদ্রোহী প্রশাসনিক কাঠামোর বিস্তার
কারেন্নি প্রতিরোধ বাহিনী সামরিক অবস্থান সংকুচিত করতে আঞ্চলিক ঘাঁটি লক্ষ্য করছে। এ অঞ্চলে কারেন্নি স্টেট ইন্টারিম এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল নামে অন্তর্বর্তী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) ছাতার তলে থাকা একাধিক গোষ্ঠীর একটি অংশ। সীমান্তবর্তী রূক্ষ গিরিখাতে স্থাপিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রে প্রায় ১৫০ বন্দি—তাদের মধ্যে ৯৯ জন সাম্প্রতিক লড়াইয়ে ধরা পড়া জান্তা সেনা। দেশজুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হেফাজতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুদ্ধবন্দি আছে বলে নাগরিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এই প্রতিরোধ প্রশাসন এখন কায়াহ ও আশপাশের শান অঙ্গরাজ্যের অংশজুড়ে ১৬টি টাউনশিপ পর্যায়ে কর সংগ্রহ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা চালাচ্ছে; কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ এখানে ক্ষীণ।
আটক কেন্দ্রের বাস্তবতা ও আচরণবিধি
গিরিখাতের গভীরে বিমান ও ড্রোন নজর এড়ানোর জন্য আড়াল করে রাখা স্থাপনায় বন্দিদের উপর ধারাবাহিক নজরদারি চলছে। পালানোর পথে পাহাড়ি-জঙ্গল পরিবেশ নিজেই কঠিন প্রাকৃতিক ‘বেষ্টনী’ তৈরি করেছে। প্রশাসন দাবি করে—আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে যুদ্ধবন্দিদের রাখা হচ্ছে; অভিযোগ উঠলে অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথাও জানানো হয়। এক প্রহরী নিজেও আগে বন্দি ছিলেন—যা বহুমাত্রিক আনুগত্যের দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে। বন্দিদের দিয়ে সবজি চাষ, কাঠের কাজ, তাঁত, টুপি তৈরি, ছোট লাইব্রেরি ও চিকিৎসা কক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ করানো হচ্ছে—স্বনির্ভরতার মাধ্যমে সরবরাহ ঝুঁকি কমানোর কৌশল।
যোগাযোগ ও প্রযুক্তিতে পরিবর্তন
আগে সীমিত ইন্টারনেট ও টেলিকম নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী কার্যক্রম সমন্বয়ে বড় বাধা ছিল। এখন স্যাটেলাইট ডিভাইস (যেমন স্টারলিংক) ও রেডিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভেতরে-বাইরে যোগাযোগ সক্ষমতা বেড়েছে। থাই সীমান্ত থেকে এক দিনেই সামনের এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে—বিদ্রোহীদের ভূখণ্ডগত অগ্রগতির ইঙ্গিত; জান্তা অনেকাংশে দুর্গম কিন্তু স্থবির ঘাঁটিতে সীমাবদ্ধ।
জান্তার পাল্টা কৌশল ও বেসামরিক চাপ
প্রতিরোধ বিস্তৃত হওয়ায় সামরিক বাহিনী নিয়মিত পাল্টা বিমান ও আর্টিলারি হামলা বাড়াচ্ছে; যুবকদের জোর করে সেনাবাহিনীতে নেয়া, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, বিচার ও মানবিক সহায়তা বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ রয়েছে। অসংখ্য পরিবার বারবার স্থানচ্যুত হচ্ছে। ডেমোসোর কাছের একটি বাস্তুচ্যুত শিবিরে ৫৮ বছর বয়সী পিও শান অঙ্গরাজ্যে নিজের ছেলে বিমান হামলায় নিহত হওয়ার পর পলায়নের বিবরণ দেন; খাদ্যসঙ্কট এড়াতে শেষ পর্যন্ত থেকে ফসল কাটার চেষ্টা করেছিলেন।
বাস্তুচ্যুতি ও খাদ্য নিরাপত্তা
স্থানীয় অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তথ্যমতে কায়াহ অঙ্গরাজ্যের আনুমানিক প্রায় অর্ধেক মানুষ স্থানচ্যুত। সীমিত জমিতেও ধান চাষের আহ্বান জানিয়ে উৎপাদিত খাদ্য সম্পূর্ণভাবে সম্প্রদায়ের ভেতরে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যুদ্ধের দীর্ঘায়িত অনিশ্চয়তায় স্থানীয় স্বশাসিত সরবরাহ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ল্যান্ডমাইন সংকট ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
কারখানার মতো বিস্তৃত সামরিক অবকাঠামো না থাকলেও বিস্ফোরক অবশিষ্ট ও ল্যান্ডমাইন নতুন বিপদ তৈরি করেছে। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ অনুসারে ২০২৩ সালে ল্যান্ডমাইন ও অবিস্ফোরিত অস্ত্রের কারণে বেসামরিক নিহত-আহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। আগের সংঘাত-বিদীর্ণ কম্বোডিয়ার মতো দেশ আজও কয়েক দশক আগের মাইন অপসারণে লড়ছে—মিয়ানমারেও দীর্ঘ ভবিষ্যৎ ঝুঁকির ইঙ্গিত রয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে অঙ্গহানি হওয়া যোদ্ধারা পুনর্জীবনচর্চার সুযোগ পাচ্ছেন; তবে মাইন পরিষ্কার একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া হিসেবে থেকেই যাবে।
পরিবেশগত চাপ ও বন ধ্বংস
বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও ক্ষুদ্র খামার বিস্তারে বন পরিষ্কার করছে; এর সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত হওয়ায় বিকল্প জ্বালানির ওপর চাপ বাড়ছে। যুদ্ধ কেবল মানবজীবন নয়—অঞ্চলের বনভূমিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর সংকট
ডেমোসোর কাছে হাসপাতাল পরিচালকেরা আতঙ্ক ও আর্থিক অস্থিরতার দ্বৈত চাপের মুখে আছেন। ল্যান্ডমাইন, আর্টিলারি ও ড্রোন হামলায় আহত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে; সরবরাহ লাইন বিঘ্নিত হওয়ায় ওষুধের দাম ও সংগ্রহঝুঁকি ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যয়সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহায়তার সীমাবদ্ধতা
আশা জাগলেও বহির্বিশ্বের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সীমিত; নিষেধাজ্ঞা আরোপের বাইরে কার্যকর সংঘাতমুখী কূটনৈতিক চাপ দুর্বল। আঞ্চলিক সমন্বয় প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সতর্ক অবস্থান পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করছে। সহায়তামূলক কিছু সংস্থা তহবিল সংকোচনে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় স্থানীয় চিকিৎসা ও ত্রাণ উদ্যোগ চাপের মুখে পড়ছে। শরণার্থী প্রবাহের গন্তব্য দেশসমূহে প্রবেশ বিধিনিষেধ বাস্তুচ্যুতদের অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
মানবিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
কায়াহ অঙ্গরাজ্যে যে ‘সমান্তরাল শাসন’ ও স্থল নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তন ঘটছে তা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কাঠামোর সংকোচনের স্পষ্ট লক্ষণ। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়তি বিমান হামলা, ব্যাপক মাইন বিস্তার, জীবিকাসংকট ও বন উজাড় একটি দীর্ঘস্থায়ী ধ্বংসস্তূপের ভিত্তি গড়ে তুলছে। যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে মানুষ পুনর্বাসন, মাইন অপসারণ, পরিবেশ পুনরুদ্ধার, খাদ্য নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার—সবগুলো ক্ষেত্রেই ব্যাপক ও ধারাবাহিক সমর্থন না পেলে ক্ষয়ক্ষতি প্রজন্ম অতিক্রম করে চলবে।
দীর্ঘস্থায়ী সংকট
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলে বর্তমান বাস্তবতা—সামরিক কৌশলে বিদ্রোহীদের অগ্রগতি, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের সংকুচন, বেসামরিক মানবিক বিপর্যয়ের তীব্রতা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা—একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের পরিপক্ব পর্যায় নির্দেশ করে। যে কোনো সমাধান পর্বে নিরাপত্তা ও মানবিক সুরক্ষা সমান্তরালে না এলে সংঘাতের সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষত আরও গভীর হবে। কায়াহর জঙ্গল আজ যে দ্বৈত চিত্র ধারণ করেছে—প্রতিরোধের ঘাঁটি ও মানুষের শেষ আশ্রয়—তা পুরো মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের প্রতীকী প্রতিফলন।