বিচারকেরা কি স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন, নাকি মব সন্ত্রাসের ভয় তাদের প্রভাবিত করছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একাধিক আইনজীবী এবং আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে।
বিচারে প্রভাব ফেলছে মবের ভয়?
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ- এইচআরপিবি এর প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টে যারা প্র্যাকটিস করে, তারা সবাই বলছে, জজ সাহেবরা এখন ভয়ে অর্ডার দিতে সাহস পাচ্ছেন না। কোন রায় দিলে কোনটা কী হয়ে যায়!”
গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে দাবিগুলো উঠেছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিল বিচার বিভাগকে আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীন করা, যাতে সরকার বা সংস্থা বা অন্য যে-কোনো গোষ্ঠীর চাপের বাইরে থেকে আদালত তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকেরা আন্দোলনকারীদের একাংশের দাবির মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন প্রধান বিচারপতি এবং বিচারক নিয়োগ করে।
কিন্তু এরপর থেকে আদালত চত্বরে আসামি এবং আইনজীবীদের ওপর হামলা, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, এমনকিনানা মামলা ও অভিযোগে জামিন, কারাদণ্ড ইত্যাদি বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা পক্ষের কথা আদালতের স্বাধীন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করছেন মনজিল মোরসেদ।
তিনি বলেন, “আগের সময় যেটা ছিল, রাজনৈতিক মামলা বা সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোতে কিছু কিছু রায় স্বেচ্ছায় দিতেন পক্ষে, আবার কিছু কিছু ভয়ও ছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকেই (এস কে সিনহা) যেহেতু দেশছাড়া করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে তাদের আবার কী অবস্থায় হয়- এই ভয়টা আগে ছিল। সেটা ছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আর বর্তমানে যেটা হয়েছে, সেটা সর্বক্ষেত্রে।”
আইনের শাসনের পথে বাধাটা আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে মনজিল মোরসেদ বলেন, “একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি (এ বি এম খায়রুল হক)। তিনি একটা রায় দিয়েছিলেন, সেটা জনগণ পছন্দ না-ও করতে পারে, করতেও পারে। সেই কারণে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হলো। আদালত তাকে জেলখানায় পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। তার কোনো বিকল্প ছিল না। প্রধান বিচারপতি তো আর হত্যায় জড়িত না, কিন্তু যদি ন্যায় বিচার থাকতো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকতো, তাহলে তো তার জামিন না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যার অধীনে ওই ম্যাজিস্ট্রেট চাকরি করেন, তাকেও তিনি জামিন দিতে পারেননি। একটা ডাহা মিথ্যা মামলায় ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে কিন্তু তাকে জেলখানায় পাঠাতে হয়েছে। এই একটা উদাহরণ থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, বিচার বিভাগের সার্বিক অবস্থা কী?”
গত সপ্তাহে ঢাকায় দৈনিক প্রথম আলোর এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেছেন, “বাংলাদেশে এখন কোনো ভয়ভীতি নেই, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। ভয় বিচারব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। বিচারপতিদের সবারই চিন্তা হচ্ছে, আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কোনো একটা গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কিছু একটা নিয়ে জোরে আওয়াজ তুললেই তো শেষ। সে বিচারপতির আর কোনো ভবিষ্যৎই থাকবে না।’’
এমন ‘ভয়ের পরিবেশ’ থাকায় বিচারকেরা রায় ঠিকমতো দিতে পারছেন না বলেও মনে করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, “রায় তো দূরের কথা, আদেশই-বা কে দেবে?” এ বিষয়ে আরো জানতে যোগাযোগ করলে ডয়চে ভেলেকে এই একই বক্তব্য ব্যবহার করতে বলেন সারা হোসেন।
বিচারবিভাগে যেসব পরিবর্তন আসছে, সেগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে আলোচনা করার পরিবেশও নেই বলে মনে করেন সারা হোসেন।
তিনি বলেন, “গত এক বছরে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা হলেও এর কাঠামোতে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। প্রাথমিকভাবে যেসব পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো ঠিক ছিল কি না, সেসব নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। হাইকোর্টের বিচারকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন? সেসব কারণ আমরা আজও জানি না। এগুলো নিয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে পত্রিকাগুলোও বেশি কিছু লেখার চেষ্টা করছে না।”
দীর্ঘ ৩৫ বছর সুপ্রিমকোর্ট বিটে সাংবাদিকতা করা কাজী আব্দুল হান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “রায়ের কারণে অবসরে যাওয়ার পর বিচারকের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা মূলক আচরণ বিচারকাজে বিচারকের স্বাধীনতার ওপর সুস্পষ্ট হুমকি। দেশের লাইফলাইন বিচার ব্যবস্থার জন্য যা অশনিসংকেত। বিচার বিভাগীয় সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনকারীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক রাখার আদেশ বিদ্বেষপ্রসূত, নাকি যথাযথ, তা পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। দেশের বিচারকদের স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে কাজ করার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে প্রতিবিধান করা উচ্চ আদালতের প্রধান (ইনহ্যারিট) দায়িত্ব। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়েই তারা এ উদ্যোগ নিতে পারেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে এমনকি হেবিয়াস-করপাস রুল জারি করে যে কোনো আটকাদেশ পরিবর্তনের ক্ষমতা তারা তাৎক্ষণিক প্রয়োগ করতে পারতেন। অথচ তারা নীরব-নির্লিপ্ত। এমন ঘটনা বিস্ময়ের এবং যে-কোনো অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারে নাগরিকদের জন্য দেশে বিচারপ্রাপ্তির পথ এর মধ্য দিয়ে রুদ্ধ হয়ে গেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।”
ব্যারিস্টার সারা হোসেনের কথার প্রসঙ্গ টেনে সুপ্রিম কোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা ডিডাব্লিউকে বলেন, “আদেশ দিলে আমি টার্গেট হয়ে যাবো, এই প্রবণতা ৫৩ বছরে প্রথম দেখছি। এই প্রবণতার মধ্যে আপনি কখনোই বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন বলতে পারেন না।”