যুদ্ধের ভয়াবহতার সাক্ষী থেকে মানবতার পথে
গাজার তরুণ ফটোসাংবাদিক মোটাজ আজায়িজা নিজের চোখে দেখেছেন যুদ্ধের নৃশংসতা। ১০৭ দিন তিনি কাজ করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রের সামনের সারিতে, নিজের পরিচিত পাড়ায়, যেখানে প্রতিদিন ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হচ্ছিল জীবন ও ঘরবাড়ি। তাঁর তোলা অপ্রস্তুত, কাঁচা ছবিগুলো এতটাই বাস্তব ও হৃদয়বিদারক ছিল যে সেগুলো উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
মূলধারার সংবাদমাধ্যম যখন গাজার ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিল না, তখন আজায়িজা ও আরও কিছু ফিলিস্তিনি সাংবাদিকই ছিলেন সেই চোখ, যারা বাইরের বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন যুদ্ধের প্রথম দিককার চিত্র।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ৯০ শতাংশেরও বেশি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। ফলে প্রায় পুরো জনসংখ্যাই বাস্তুচ্যুত।
মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরে নতুন জীবনের খোঁজে
আজায়িজা বলেন, “আমার জীবন এখন মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। অনেক গাজাবাসী মারা গেছেন, কিন্তু কেউ তাঁদের নামও উচ্চারণ করে না।”
২১ মাস আগে তিনি পরিবারসহ কাতারে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এখন তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি মানবিক সহায়তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন এবং দাবি করেছেন, তিনি এখন পর্যন্ত ৬ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছেন, যা দিয়ে বহু জীবন বাঁচানো গেছে।

তিনি সম্প্রতি “মোটাজ ফাউন্ডেশন” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন, যার মাধ্যমে গাজার মানুষের জন্য খাবার, পানি, কম্বল ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, এটি “অন্ধকারে একটি প্রদীপ।”
মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে সংগ্রাম
জর্জিয়ার রসওয়েলে মুসলিম ওয়েলনেস সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কেন ফাউন্ডেশনের নাম নিজের নামে রেখেছেন। তিনি উত্তর দেন, “অন্য কিছু ভাবতে পারিনি, কিন্তু এই কাজই আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে।”
ইয়েমেনি এক কফিশপের পেছনে দাঁড়িয়ে আজায়িজা বলেন, “যখন আমি সাহায্যের অর্থ পাঠাই বা কাউকে খাদ্য সহায়তা দিই, তখন আমি এক ধরনের উল্লাস অনুভব করি। হয়তো এভাবেই আমি আমার মানসিক কষ্ট ভুলতে চেষ্টা করি।”
তিনি বলেন, “আমি কখনও অকাজের মানুষ ছিলাম না, সব সময় কিছু না কিছু করে যেতে চেয়েছি।”
সাংবাদিক হত্যার ভয়ংকর বাস্তবতা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলি পাল্টা অভিযানে ১,২০০ জন নিহত ও প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। এরপর থেকে গাজায় সাংবাদিকদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস জানায়, তখন থেকে ২৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

আজায়িজা বলেন, গাজা ছাড়ার আগে তিনি মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন অজ্ঞাত ফোনকলের মাধ্যমে। মৃত্যুর এত কাছাকাছি পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা তাঁকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাঁর ভাষায়, “এখন মনে হয়, হারানোর কিছুই নেই।”
মৃত্যুর মাঝেও আত্মার নিস্তব্ধতা
তিনি অসংখ্য বন্ধুকে হারিয়েছেন, কিন্তু নিজের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করেন। “আমার আত্মা নিভে গেছে,” তিনি বলেন। বেঁচে থাকা নিয়ে তাঁর মধ্যে কাজ করে প্রবল অপরাধবোধ, যা অনেক শরণার্থী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের মধ্যেও দেখা যায়।
“ইসরায়েল চায় আমরা ভেতর থেকে ভেঙে পড়ি,” তিনি বলেন। “তাহলে আর কিছুই করার দরকার হবে না। আমি সেই অনুভূতি পাই, কিন্তু তাকে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে দিই না।”
ক্যামেরার পেছনের শিল্পী থেকে যুদ্ধের সাক্ষী
আজায়িজা সবসময়ই ছবি তুলতে ভালোবাসতেন, কিন্তু যুদ্ধ তাঁকে বাধ্য করেছে এক অন্য বাস্তবতায়। আগে তিনি শিশুদের খেলা, বাজারের রঙিন দৃশ্য, সৈকতের মুহূর্ত বন্দি করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু যুদ্ধের ছবি তোলাই তাঁর পেশা হয়ে দাঁড়ায়—একটি বেদনাদায়ক বাধ্যবাধকতা হিসেবে।
২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে একটি বিধ্বস্ত ভবনে আটকে পড়া এক নারীর ছবি তোলেন তিনি। টাইম ম্যাগাজিন সেটিকে বছরের সেরা ১০ ছবির মধ্যে একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আজায়িজার কাছে এই স্বীকৃতি ছিল যন্ত্রণার প্রতীক—কারণ এটি এসেছিল তাঁর সমাজের অশেষ কষ্টের বিনিময়ে।

ভবিষ্যতের স্বপ্ন: ক্যামেরায় প্রাণ, মানব নয়
আজায়িজা বলেন, তিনি কখনও নায়ক হতে চাননি। তাঁর ১ কোটি ৫০ লাখ ইনস্টাগ্রাম অনুসারী থাকলেও তিনি এখনও আগের মতোই একজন সাধারণ মানুষ।
কিন্তু অনলাইনে কিছু মানুষ তাঁকে অপমান, হিংসা ও আক্রমণের লক্ষ্য করছে। তাঁর ভাষায়, “গুলির আঘাতের যন্ত্রণা জানা যায়, কিন্তু ঘৃণার শব্দ ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে।”
তিনি যোগ করেন, “এই ঘৃণা তোমার হৃদয়কে আঁটসাঁট করে দেয়, পেটে অস্বস্তি তৈরি করে, মাথায় চিন্তার ভার বাড়ায়। আমাদের বিভক্ত করতে বাইরের কারও প্রয়োজন নেই; আমরা নিজেরাই বিভক্ত।”
যুদ্ধবিরতি ও হতাশার মধ্যে আশা
তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য কৃতজ্ঞ, কিন্তু মনে করেন এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায্য নয়। তাঁর ভাষায়, “আমরা শুধু গণহত্যা বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শান্তি কেবল ইসরায়েলকেই আরও শক্তি দিয়েছে।”
জাতিসংঘের স্বাধীন অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলেছে, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে—যা ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করেছে।
এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন
আজায়িজা এখন মানবিক কাজে মনোযোগী, কিন্তু একপ্রকার অচল অবস্থায় আছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন গাজায় ফিরে সমুদ্রের ধারে একটি ঘর বানানোর। তিনি বলেন, একদিন হয়তো গাজার যুবমন্ত্রী হতে চান, তবে জানেন রাজনীতি প্রায়শই মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে।
সবচেয়ে বড় ইচ্ছা তাঁর—একটি সহজ জীবন, হাতে ক্যামেরা নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো।
“তুমি টারজানের কথা জানো?” তিনি হেসে বলেন। “আমি টারজানের মতো হতে চাই—হাতে ক্যামেরা নিয়ে তানজানিয়ার জঙ্গলে সিংহ-চিতা ধরতে। আমি আর মানুষের ছবি তুলতে চাই না। মানুষ শুধু কষ্ট আর বিপর্যয় বয়ে আনে। এখন থেকে শুধু প্রাণীর ছবি—শুধু তারা, মানুষ নয়।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















