মার্কিন বাণিজ্য ব্যবস্থায় নতুন সংকট
মার্কিন শিল্প প্রতিষ্ঠান OTC Industrial Technologies–এর প্রধান নির্বাহী বিল কেনেডি জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধারাবাহিক শুল্ক আরোপের ফলে তাদের সরবরাহ চেইন বিপর্যস্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগে চীনের পর ভারতে কম খরচে যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করত, কিন্তু এখন সেসব দেশেও ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপে ব্যয় আরও বেড়েছে।
“আমরা চীন থেকে সরিয়ে অন্য দেশে গিয়েছিলাম, এখন সেখানে শুল্ক আরও বেশি,” বলেন কেনেডি। “আমাদের এখন বাঁচার চেষ্টা করতে হবে, নইলে সবাই অচিরেই ক্ষতিগ্রস্ত হব।”
আদালতে ট্রাম্পের শুল্কের বৈধতা প্রশ্নে শুনানি
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এখন চলছে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বৈধতা নিয়ে শুনানি। এর আগে নিম্ন আদালত রায় দিয়েছিল যে ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের International Emergency Economic Powers Act (IEEPA)–এর অধীনে জরুরি ক্ষমতা অতিক্রম করেছেন। তবে আদালতের ৬-৩ রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ট্রাম্পের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
এই আইন মূলত প্রতিপক্ষ দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রথমবারের মতো এটিকে ব্যবহার করেন শুল্ক আরোপের জন্য, যা অভূতপূর্ব। তিনি ২০২৪ সালে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিকে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেন।

ট্রাম্পের যুক্তি: ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য শুল্ক অপরিহার্য’
ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, “যদি শুল্ক না থাকে, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা থাকবে না। অন্য দেশগুলো বছরের পর বছর আমাদের সুযোগ নিয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “চীনসহ অনেক দেশ আমাদের ক্ষতি করেছে, কিন্তু এখন আর তা হবে না। শুল্ক আমাদের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিয়েছে।”
সরকার বলছে, শুল্ক থাকছেই
মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি IEEPA–ভিত্তিক শুল্ক বাতিলও করে, প্রশাসন তখনও বিকল্প আইনি পথে শুল্ক বজায় রাখবে।
তার ভাষায়, “যেকোনো অবস্থায় শুল্ক থাকবে। আমরা চাইলে Trade Act 1974-এর 122 ধারা বা Tariff Act 1930-এর 338 ধারা ব্যবহার করতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক হ্রাসে চুক্তি করেছে, তাদের চুক্তি মেনে চলা উচিত।”
অন্যান্য আইনি পথে শুল্ক আরোপ
IEEPA ছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যেই শুল্ক আরোপ করছে Trade Expansion Act 1962-এর 232 ধারা ও Trade Act 1974-এর 301 ধারা অনুযায়ী। এর আওতায় শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে গাড়ি, তামা, সেমিকন্ডাক্টর, ফার্মাসিউটিক্যালস, রোবোটিকস ও বিমান শিল্পে।
ওয়াশিংটনের ট্রেড আইনজীবী টিম ব্রাইটবিল বলেন, “এই প্রশাসন শুল্ককে অর্থনৈতিক নীতির মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। কোম্পানিগুলোকে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে।”

বাণিজ্যিক আলোচনা ও বৈদেশিক প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, শুল্ক নীতির কারণে জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বড় বাণিজ্য অংশীদাররা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বড় ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছে।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে ১৯%-২০% হারে শুল্ক নির্ধারণ করে চুক্তি করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় সম্মত হয়ে গাড়ি ও অন্যান্য পণ্যে ১৫% শুল্ক পেয়েছে।
তবে চীনের সঙ্গে আলোচনা সবচেয়ে জটিল হয়ে উঠেছে, কারণ তারা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় দুর্লভ খনিজ ও চুম্বক পদার্থ সরবরাহ সীমিত করছে।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং–এর সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ফেন্টানিল-সম্পর্কিত শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে ১০% করেন এবং প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর নতুন নিয়ন্ত্রণ এক বছর স্থগিত রাখেন। এর বিনিময়ে চীন এক বছরের জন্য কঠোর রপ্তানি লাইসেন্স স্থগিত রাখবে এবং আমেরিকান সয়াবিন ক্রয় পুনরায় শুরু করবে।
রাজস্ব ও বিনিয়োগের প্রভাব
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, যদি সুপ্রিম কোর্ট IEEPA শুল্ক বাতিল করে, তাহলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। কারণ সরকারকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি শুল্ক ফেরত দিতে হতে পারে।
এই বছর সংগৃহীত IEEPA শুল্কই ২০২৫ অর্থবছরে কাস্টমস রাজস্ব ১১৮ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি কিছুটা কমাতে সাহায্য করেছে।

অর্থনীতিবিদ এরনি টেডেস্কি বলেন, “শুল্ক রাজস্বে সরকারের আসক্তি তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে কমানো কঠিন হবে।”
মূল্যস্ফীতি ও ভোক্তা প্রভাব
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই শুল্কের বাড়তি খরচ বহন করছে, ফলে ভোক্তা দামের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত হয়েছে। তবে অক্সফোর্ড ইকোনমিকস–এর বিশ্লেষণ বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে শুল্কের প্রভাবে ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI) বছরে ০.৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভের জন্য উদ্বেগজনক।
কর্পোরেট দিক থেকে, বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি এখন পর্যন্ত ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি শুল্কজনিত ক্ষতির কথা জানিয়েছে।
ব্যবসায়িক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ
ওহাইও-ভিত্তিক OTC কোম্পানির প্রধান কেনেডি বলেন, “এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে উৎপাদন কোথায় সরানো হবে—উচ্চমানের পণ্যের জন্য দেশে ফিরতে হতে পারে, আর কম দামের অংশগুলোর জন্য মেক্সিকোতে যেতে হবে।”
তার মতে, “নতুন স্বাভাবিক অবস্থা হবে ১৫% শুল্ক। প্রশাসন যেভাবে বলুক না কেন, এই শুল্ক দীর্ঘমেয়াদে থাকবে।”
সুপ্রিম কোর্টের রায় যাই হোক না কেন, ট্রাম্প প্রশাসন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে শুল্ক নীতি মার্কিন অর্থনীতির স্থায়ী অংশ হয়ে থাকবে। এই অবস্থায় কোম্পানি, বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হবে কীভাবে তারা নতুন শুল্ক বাস্তবতায় নিজেদের খাপ খাওয়াবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















