যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন অর্থনীতি বা আর্থিক বাজারে ধস নামেনি, তা বোঝার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্য জোট থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেয়—যদিও এর সমাপ্তি খুব সুখকর ছিল না।
অর্থনৈতিক পরিসর ও বৈশ্বিক প্রভাব আলাদা হলেও, দুই ঘটনায় একটি বড় মিল রয়েছে—দীর্ঘদিনের মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাকে হঠাৎ উল্টেপাল্টে দেওয়া এবং ব্যবসা, সামগ্রিক অর্থনীতি ও আর্থিক বাজারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোট এবং চলতি বছরের ট্রাম্পের শুল্ক নীতিকে আর্থিক ‘ঝাঁকুনি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। বাস্তবে, সূচনাপর্বে তেমন ভয়াবহ কিছু দেখা যায়নি।
দুটি ঘটনার পরই সংশ্লিষ্ট মুদ্রাগুলোর দাম নাটকীয়ভাবে পড়ে যায়। গণভোটের পর স্টার্লিংয়ের পতন এবং ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ডলারের দুর্বলতা বিশ্ববাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদরের ওপর চাপ কিছুটা শোষণ করে নিয়েছিল।

তবে সামগ্রিকভাবে তাৎক্ষণিক ক্ষতির পরিমাণ আলাদাভাবে মাপা কঠিন হওয়ায় সমালোচকদের আশঙ্কা সত্যি হয়নি—‘বড়সড় ধস’ দেখা দেয়নি। তবু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষয় ও সম্ভাবনা হারানোর ধীর আগুন জ্বলে যেতে পারে, যা বিভিন্ন বাহ্যিক ঝড়ো হাওয়ায় আড়াল হয়ে যায়।
ধীর ক্ষয়
ব্রিটেনের ক্ষেত্রে, কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাত ব্রেক্সিটের প্রকৃত প্রভাব নির্ণয়কে জটিল করে তোলে। ইইউ-এর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর দেশটির আনুষ্ঠানিক বেরিয়ে আসা ঘটে ২০২০ সালের ঠিক আগমুহূর্তে, আর নতুন বাণিজ্য বিধি চালু হয় আরও এক বছর পরে।
গণভোট এবং মহামারির মধ্যবর্তী চার বছরে যুক্তরাজ্যে মন্দা দেখা যায়নি, ছিল না নেতিবাচক কোনো ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি—যা তখন ইইউ-পন্থীদের অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে ব্রেক্সিট-পক্ষকে উৎসাহ জুগিয়েছিল।
কিন্তু মহামারি ও ব্রেক্সিটের যুগপৎ আঘাতের পর অর্থনীতি প্রায় স্তিমিত।
দুর্বল পাউন্ডের সহায়তায় এফটিএসই-১০০ সূচক শুরুতে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ ও বিশ্ব সূচকের সঙ্গে তাল মিলিয়েছিল; তবে ২০১৮ সালের পর থেকে যুক্তরাজ্যের বাজার এমএসসিআই অল-কান্ট্রি সূচকের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে।

আর স্টার্লিংয়ের কার্যকর বিনিময় হারকে ২০১৬-র পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে আট বছরের বেশি সময় লেগেছে।
মূলধারার অর্থনীতিবিদদের এখন খুব কমই সন্দেহ আছে যে ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বড় আঘাত হেনেছে—যদিও দোষারোপের তির বিভিন্ন দিকে ছোড়া হয়—এবং নির্দিষ্ট ক্ষতি নিরূপণে অজস্র গবেষণা হয়েছে।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের অর্থনীতিবিদদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনিশ্চয়তার সময়ে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের আগে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে তেমন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু নতুন নিয়ম চালু হলে আমদানি ৩ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি ৬.৪ শতাংশ কমেছে, যার মধ্যে ইইউ-তে রপ্তানি ১৩ শতাংশ কমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই পতন সরকারি দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের তুলনায় তুলনামূলকভাবে ছোট মনে হলেও ক্ষতির বেশি বোঝা গেছে ছোট ব্যবসাগুলোর কাঁধে। এ ছাড়া সেবাখাত ও লন্ডনের আর্থিক খাতের ক্ষয় এই হিসাবে ধরা পড়েনি, যা আরও বড় ধাক্কা দিয়েছে এবং আগামী দশ বছরে সম্মিলিত ক্ষতি ‘সিটি’-কে ভাবাচ্ছে।
‘আগুন জ্বালানো’
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কাহিনী অবশ্যই ভিন্ন মাত্রার, কারণ এর প্রতিধ্বনি বিশ্ব অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে। তবু বাজারের কিছু প্রতিক্রিয়া এবং প্রাথমিক টেকসইপনা দুই ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য সৃষ্টি করে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সময়ের সাথে শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ০.৫ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে—যা ১৫০-৩০০ বিলিয়ন ডলারের আঘাত। যদিও কষ্টকর, এটি ২ শতাংশ হারে বাড়তে থাকা বিশাল অর্থনীতির জন্য তাৎক্ষণিক সংকট নয়, যেখানে আমদানি পণ্যের অংশ মাত্র ১১ শতাংশ এবং প্রযুক্তি-এআই প্রবণতা প্রবল সহায়ক।

তবে সাবেক হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা জেসন ফারম্যানের ভাষায়, এই ক্ষতি এককালীন নয়। তাঁর মতে, জিডিপির ০.৫ শতাংশ হারানো মানে ‘আমেরিকার প্রতিটি পরিবার বছরে প্রায় ১,০০০ ডলার আগুনে ফেলে দিচ্ছে—এবং সেটা প্রতি বছরই করে যাবে, চিরকাল।’
দীর্ঘ ছায়া
ব্রিটিশ উদাহরণটি দেখায়, এ ধরনের বৃহৎ নীতিগত পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে চরম দলীয় তর্ক আধুনিক, অভিযোজিত ও জটিল অর্থনীতিতে সহজে নিষ্পত্তি হয় না। বড়সড় ধসের অনুপস্থিতি নীতি-নির্ধারকদের এমন উপলব্ধি দিতে পারে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধ পদক্ষেপগুলো কার্যকর; ফলে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ না পেয়ে সেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির শক্তি শুষে নিতে পারে।
অনেকে যুক্তি দেন, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাজনীতি সর্বদা অর্থনৈতিক রীতিনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু ভুল পথে গেলে মানুষ কি শেষ পর্যন্ত টের পায়?
সাম্প্রতিক ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটেনের ৫৬ শতাংশ মানুষ এখন মনে করেন ইইউ ছাড়া যাওয়া ভুল ছিল—যদিও বিচ্ছেদের ভোটের নয় বছর পার হয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও সম্পন্ন হয়নি।
মাইক ডোলান 


















